Skip to main content

সূরা আলে-ইমরান এর (১৫-১৭) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: জান্নাত, যা দুনিয়া ও তার সৌন্দর্যের চেয়ে উত্তম।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ (15) الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ (16) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ (17) [سورة آل عمران: 15-17]

আলোচ্য বিষয়: জান্নাত, যা দুনিয়া ও তার সৌন্দর্যের চেয়ে উত্তম।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
১৫। হে নবী! আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব এর চেয়ে উত্তম বস্তুর? মোত্তাকীদের জন্য রয়েছে তাদের রবের কাছে এমন জান্নাত, যার নিচে প্রবাহমান আছে নদীসমূহ, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, এবং পবিত্র স্ত্রীগণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে; আর আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা বান্দাদের সম্পর্কে।
১৬। যারা বলে, হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি; অতএব আমাদেরকে ক্ষমা করুন আমাদের পাপসমূহ, এবং আমাদেরকে রক্ষা করুন জাহান্নামের আযাব থেকে।
১৭। যারা ধৈর্যশীল, যারা সত্যবাদী, যারা অনুগত, যারা দানশীল এবং রাতের শেষাংশে ক্ষমাপ্রার্থী।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে চৌদ্দ নাম্বার আয়াতে উল্লেখিত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম বস্তুর সংবাদ মানবজাতিকে প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন: হে আল্লাহর নবী! আপনি তাদেরকে বলুন: আমি তোমাদেরকে লোভনীয় ছয়টি বস্তুর চেয়ে উত্তম কোন বস্তুর সংবাদ দিবো কি? তাহলে জেনে রাখো, যারা দুনিয়াতে তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবনযাপন করে, তাদের জন্য আখেরাতে স্থায়ী ভোগবিলাসের জন্য তিনটি মহামূল্যবান বস্তু অবধারিত:
(ক) এমন আকর্ষণীয় মহামূল্যবান জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির নদীসমূহ প্রবাহমান রয়েছে।
(খ) হায়েজ-নেফাস থেকে পুতপবিত্র চিরকুমারী রমনী।
(গ) আল্লাহর সন্তুষ্টি।
সুতরাং সতর্ক হয়ে যাও, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।
নিম্ন বর্ণিত গুণে গুণান্বিত মোত্তাকিগণ উল্লেখিত পুরস্কার ভোগ করবে:
(ক) যারা অন্তর দিয়ে ঈমান গ্রহণ করে এবং মুখে জোড়ালোভাবে তার স্বীকৃতি প্রদান করে।
(খ) কৃতগুণাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
(গ) জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে।
(ঘ) বিপদেআপদে, সৎআমল করতে, হক্বের উপর অটুট থাকতে এবং দ্বীন প্রচারের কাজে ধৈর্যধারণ করে।
(ঙ) বিশ্বাস, কথা ও কাজে সত্যবাদী হয়।
(চ) বিনয়ের সাথে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) অনুসরণ করে।
(ছ) সাধ্যমতো গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে দান করে।
(জ) শেষরাতে তাহাজ্জুদ সালাতে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/২৯৫, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫১-৫২, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৫-৮৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(ذَلِكُمْ) “ঐগুলো”, ইঙ্গিতসূচক সর্বনাম। এর দ্বারা চৌদ্দ নাম্বার আয়াতে উল্লেখিত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ) “পুতপবিত্র স্ত্রী”, জান্নাতের হুর কে বুঝানো হয়েছে, যা হায়েজ-নেফাসের রক্ত সহ সকল ধরণের কদর্য ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে পুতপবিত্র। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/১৫) ।
(الْأَسْحَارِ) “রাতের শেষাংশ”, সুবহে সাদিকের খুব কাছাকাছি সময়, রাতের একেবারে শেষাংশ, যে সময়ে রাতের আধার দিনের আলোর সাথে মিশে যায়। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭১)।

আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াত তথা চৌদ্দ নাম্বার আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, “আল্লাহর কাছে উত্তম আশ্রয়স্থল বা ভোগসামগ্রী রয়েছে”। আর অত্র আয়াতসমূহ তথা (১৫-১৭) নাম্বার আয়াতে উক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রদান করে বলা হয়েছে: আল্লাহর কাছে বিরাজমান উত্তম ভোগসামগ্রী হলো: জান্নাত, পুতপবিত্র রমনী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি, যা আটটি গুণে গুণান্বিত মোত্তাক্বীদের জন্য অবধারিত। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পনের নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর লোভনীয় ছয়টি বস্তুর চেয়ে উত্তম এবং স্থায়ী তিনটি ভোগসামগ্রীর কথা বর্ণনা করেছেন। তিনটি বস্তুর সমন্বয়ে এমন একটি প্যাকেজ, যার মাধ্যমে একজন জান্নাতী আত্মিক এবং দৈহিক দুই ধরণের প্রশান্তি অনুভব করবেন। যেমন: তিনটি বস্তুর প্রথমটি হলো: জান্নাত, যা বিলাসবহুল থাকার জায়গা, দ্বিতীয় নাম্বার হলো: পুতপবিত্র রমনী, যা নয়নাভিরাম জান্নাতে ভোগবিলাসের জন্য রাখা হয়েছে। এ দুইটির মাধ্যমে একজন জান্নাতী সেখানে দৈহিক শান্তি অনুভব করবে। আর তৃতীয় নাম্বার হলো: আল্লাহর সন্তুষ্টি, এর মাধ্যমে একজন জান্নাতী আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করবে। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭২) ।

২। পনের নাম্বার আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের অন্তর্নিহিত গোপন বিষয়, তাদের বাহ্যিক কৃতকর্ম এবং তাদের তাক্বওয়া সম্পর্কে স্ববিস্তারিক জ্ঞান রাখেন।
কোন কোন তাফসীরকারক অত্র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেছেন: আল্লাহ তায়ালা তাদের তাক্বওয়া সম্পর্কে স্ববিস্তারিক জ্ঞান রাখেন। এ তথ্যের আলোকেই মহান ন্যায়পরায়ণ আল্লাহ তায়ালা হাশরের ময়দানে মানবজাতির বিচার করবেন। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৭৩)। কেউ তার কোন অপকর্মকে অস্বীকার করলে তার নিজস্ব অঙ্গ-প্রতঙ্গকে সাক্ষী হিসেবে দাড় করানো হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
﴿الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾ [سورة يس: ৬৫].
অর্থাৎ: “আজ আমি তাদের মুখের উপর মোহর মেরে দিবো; তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে, তাদের পাগুলো তাদের কৃত অপকর্মের সাক্ষ্য দিবে” (সূরা ইয়াসিন: ৬৫) । সূরা নূর এর ২৪ নাম্বার আয়াতেও অনুরুপ বর্ণনা এসেছে।

৩। পনের নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় আল্লাহর কাছে বিরাজমান স্থায়ী ভোগসামগ্রী কেবল মোত্তাক্বীগণ ভোগ করতে পারবেন। এ জন্যই ইসলামের সকল আয়োজন, যেমন: সালাত, সওম, হজ্জ ইত্যাদি একজন মুমিনকে মোত্তাক্বী বানানোর জন্য।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছে বিদ্যমান স্থায়ী ভোগসামগ্রী লাভের জন্য মুমিন অথবা মুসলিমকে বাদ দিয়ে মোত্তাক্বীকে খাস করলেন কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর হলো: একজন মুমিনের চারটি স্তর আছে:
(ক) ঈমান বা মুমিনের স্তর, যারা শুধু ঈমানের ৬টি রুকনকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। এদের সংখ্যা খুব কম।
(খ) ইসলাম বা মুসলিমের স্তর, যারা ঈমানের ঘোষণা প্রদানের পাশাপাশি সালাত, সাওম, যাকাত এবং হজ্জ পালন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশী। এ দুই স্তরের মানুষ প্রথম ধাপে জান্নাত পাবে না, এ জন্য স্থায়ী ভোগসামগ্রী লাভের ক্ষেত্রে তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
(গ) তাক্বওয়া বা মোত্তাক্বীর স্তর, যারা ঈমান এবং ইসলামের চর্চা করতে করতে এমন পর্যায় পৌঁছে গেছে যে অপরাধে জড়াতে চাইলেও আল্লাহর ভয়ের কারণে জড়াতে পারে না, অথবা ভুলক্রমে জড়িয়ে পড়লেও সাথে সাথে অনুশোচনা করে তাওবা-ইস্তেগফার করে। এদের সংখ্যা কম। এ স্তরের মানুষ হিসাবনিকাসের পর প্রথম ধাপেই জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(ঘ) ইহসান বা মুহসিনের স্তর, যারা ঈমান, ইসলাম ও তাক্বওয়ার চর্চা করতে করতে এমন পর্যায় পৌঁছে গেছে যে তারা কোন অপরাধে জড়ানোর কথা ভাবতেই পারে না। সাহাবীদের বিশাল অংশ এ স্তরের অন্তভর্ভূক্ত ছিলেন। বর্তমানে এদের সংখ্যা খুবই কম। এ স্তরের মানুষ সহজ হিসাবনিকাসের পর প্রথম ধাপেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যা সূরা ইনশেক্বাক্ব এর আট নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে।
মুমিনের চারটি স্তর সম্পর্কে একটি আয়াতে এসেছে:
﴿لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوْا وَأَحْسَنُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾ [سورة المائدة: ৯৩].
অর্থাৎ: “যারা ঈমান এনেছে এবং নেকআমল করেছে, নিষেধাজ্ঞার পূর্বে তারা যা খেয়েছে তার জন্য তাদের গুনাহ হবে না। তবে শর্ত হলো: ভবিষ্যতে যদি তারা ঈমান, নেকআমল ও তাক্বওয়ার সাথে জীবনযাপন করে। অতঃপর তারা ঈমান আনে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে; অতঃপর তারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং ইহসান করে। আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালোবাসেন” (সূরা মায়িদাহ: ৯৩) ।
এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِى بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِى يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِى يَسْمَعُ بِهِ ، وَبَصَرَهُ الَّذِى يُبْصِرُ بِهِ ، وَيَدَهُ الَّتِى يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِى يَمْشِى بِهَا ، وَإِنْ سَأَلَنِى لأُعْطِيَنَّهُ ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِى لأُعِيذَنَّهُ ، وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَىْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِى عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ ، يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ” (صحيح البخاري: ৬০৫২).
অর্থাৎ: “আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন বন্ধুর সাথে দুশমনি করবে, আমি সার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, কেবল তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তবে নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে দ্বিধা করি না, যতটা দ্বিধা করি মুমিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি” (সহীহ আল-বুখারী: ৬০৫২) ।
একজন মুমিন মোত্তাক্বী কিনা তা সে নিজেই পরীক্ষা করতে পারেন। পরীক্ষা করার সহজ উপায় হলো: যে কোন ধরণের খারাপ কাজে লিপ্ত হতে গেলেই আল্লাহর উপস্থিতির কথা স্মরণ করে তা থেকে বিরত থাকা। এ লক্ষণ যার ভিতর পরিলক্ষিত হবে সে আল্লাহর কাছে মোত্তাক্বী হিসেবে গণ্য হবে। এ অবস্থার উপর দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলে একপর্যায়ে সে মুহসিনের স্তরে উন্নিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

৪। পনের নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় কে কতটুকু তাক্বওয়ার অধিকারী তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন। এজন্য মানুষ যাকে তার বাহ্যিক বেসবুসা দেখে মোত্তাক্বী বা বুযূর্গ ধারণা করে, আল্লাহর কাছে সে মোত্তাক্বী নাও হতে পারে। কোরআন-সুন্নাহের অনেক জায়গায় দেখতে পাই দুনিয়ায় মোত্তাক্বী হিসেবে খ্যাত কিছু মানুষকে জাহান্নামে দেখতে পেয়ে তার ভক্তবৃন্দ রীতিমতো হতভাগ হবে। সুতরাং আমাদের উচিৎ মানুষকে পরোয়া না করে আল্লাহর দফতরে মোত্তাক্বী হিসেবে নাম লেখানোর জন্য চেষ্টা করা। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৫।ষোল এবং সতের নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে সকল মোত্তাক্বীগণ আখেরাতের স্থায়ী ভোগসামগ্রী লাভে ধন্য হবেন তাদের আটটি গুণ বর্ণনা করেছেন:
(ক) যারা অন্তর দিয়ে ঈমান গ্রহণ করে এবং মুখে জোড়ালোভাবে তার স্বীকৃতি প্রদান করে।
(খ) কৃতগুণাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়।
(গ) জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে।
(ঘ) বিপদেআপদে, সৎআমল করতে, হক্বের উপর অটুট থাকতে এবং দ্বীন প্রচারের কাজে ধৈর্যধারণ করে।
(ঙ) বিশ্বাস, কথা ও কাজে সত্যবাদী হয়।
(চ) বিনয়ের সাথে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) অনুসরণ করে।
(ছ) সাধ্যমতো গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে দান করে।
(জ) শেষরাতে তাহাজ্জুদ সালাতে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করে।

আয়াতের আমল:
আখেরাতে মুক্তি এবং স্থায়ী ও উত্তম ভোগসামগ্রী লাভের জন্য আয়াতে বর্ণিত একজন মোত্তাক্বীর আটটি গুণ দিয়ে দৈনন্দিন জীবনকে সাজানো।

সূরা আলে-ইমরানের চৌদ্দ নাম্বার আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: পৃথিবীর লোভনীয় বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসা একটি পরীক্ষা।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ (১৪) [سورة آل عمران: ১৪].

আয়াতের আলোচ্যবিষয়:
পৃথিবীর লোভনীয় বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসা একটি পরীক্ষা।

আয়াতের সরল অনুবাদ ও শব্দার্থ:
সুশোভিত করা হয়েছে মানুষের নিকট লোভনীয় বস্তুসমূহের প্রতি ভালোবাসাকে: নারী, সন্তানসন্ততি, রাশি রাশি সোনা-রুপা, চিহ্ণিত ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু এবং শস্যক্ষেত; এগুলো ভোগসামগ্রী পার্থিব জীবনের; আল্লাহ তায়ালার নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।

আয়াতের ভাবার্থ:
নিশ্চয় মানবজাতিকে পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টিগতভাবে ৬টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি আসক্ত করে সৃষ্টি করা হয়েছে: (ক) নারী, (খ) সন্তানসন্ততি, (গ) রাশি রাশি সোনা-রূপা, (ঘ) পছন্দসই চিহ্ণিত ঘোড়া, (ঙ) গবাদি পশু, যেমন: উট, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি এবং (চ) শস্যক্ষেত। এ লোভনীয় বস্তুগুলো আখেরাতে কারো কোন উপকার করতে পারবে না, যদি তার মধ্যে ঈমান, সৎআমল, শীরক-কুফরীর প্রতি ঘৃণা এবং উল্লেখিত বস্তুগুলোকে ব্যবহার করার ইলাহী বিধান জানা না থাকে। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেছেন: কিন্তু এগুলো ক্ষণিকের এ দুনিয়ার ভোগ্যসামগ্রী মাত্র, যা মৃত্যুর সাথে সাথে ভোগকারীর জীবন থেকে নিঃশেষ হয়ে যাবে, আর আল্লাহর নিকট রয়েছে স্থায়ী জান্নাতের উত্তম ভোগসমগ্রী। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৪২, আল-মুন্তাখাব: ১/৮৫, আল-মুয়াসসার: ১/৫১, আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/২৯২) ।

আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(الشَّهَوَاتِ) ‘লোভ-লালসা’, সকল তাফসীরের ভাষ্যমতে অত্র আয়াতে ‘লোভ-লালসা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘লোভনীয় বস্তুসমূহ’। এখানে শব্দমূল ব্যবহার করে ঐ শব্দের অর্থটি যে সকল বস্তুর সাথে প্রযোজ্য হয় তা উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এ রকম ব্যবহার আরবী ভাষায় সচরাচর পাওয়া যায়। যেমন: ‘পান করা’ শব্দ ব্যবহার করে পানোপযুক্ত সকল বস্তুকে বুঝানো হয়।
ইমাম জমাখশারী (র.) আরবী ভাষায় এ রকম ব্যবহারের উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: এতে অর্থের আধিক্যতার প্রতি ইঙ্গিত আছে। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শাহওয়াত বা লোভ-লালসা বেশী থাকা পশুর গুণ। মানুষ যখন আয়াতে উল্লেখিত ছয়টি বস্তুর প্রতি বেশী আসক্ত হয়, তখন সে পশুর পর্যায় নেমে যায়। সুতরাং আয়াতে এ শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৪২) ।
(الْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ) ‘আল-ক্বানাতীরুল মুক্বানতারা’, ‘আল-ক্বানাতীর’ আরবী ভাষার বহুবচনের শব্দ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: রাশি রাশি সম্পদ। এর এক বচনের শব্দ হলো: ‘ক্বিনতার’। এর পরিমাণ নিয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়। ইমাম জাযায়িরী (র.) তার তাফসীর গ্রন্থে একটি মত দিয়েছেন, তা হলো: এক ক্বিনতার হলো: ১১০০ আওক্বিয়া রুপা। আর ‘আল-মুক্বানতারা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অঢেল বা রাশি রাশি। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৯২) ।
বর্তমান প্রচলিত পরিমাপে এর ওজন দাড়ায় প্রায় ১৩১ কেজি রুপা। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১০ কোটি ৬১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। আর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ‘ক্বিনতার’ এর বহুবচনের রুপ ব্যবহার করে রাশি রাশি সম্পদের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। (আল্লাহ ভালো জানেন)
(مَتَاعُ) ‘ভোগ্যসামগ্রী’, দুনিয়ার উপভোগ্য বস্তুর ক্ষেত্রে আরবী ভাষায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়; কারণ এর অর্থের মধ্যে হারিয়ে ফেলা বা আলাদা হওয়ার একটি অর্থ রয়েছে, অর্থাৎ দুনিয়ার ভোগ্য সামগ্রীকে ভোগকারী যে কোন মুহুর্তে হারিয়ে ফেলতে পারে। হয়তো ভোগসামগ্রী ভোগকারী থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে, নয়তো ভোগকারী তার ভোগসামগ্রী থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে পৃথক হয়ে যাবে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/১৪) ।

আয়াতের সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলী তথা (১০-১৩) নাম্বার আয়াতে দুনিয়ার ধনসম্পদ, সন্তানসন্তুত এবং ভোগসামগ্রীর মোহে পড়ে আখেরাত থেকে বিমুখ হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আর অত্র আয়াতে দুনিয়ার ছয়টি অতি লোভনীয় বস্তুর উল্লেখপূর্বক মানবজাতিকে সতর্ক করা হয়েছে যে অতি মোহের কারণে উল্লেখিত বস্তুর ভালোবাসার জালে যেন কেউ আটকিয়ে না যায় এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে দুনিয়ার ভোগবিলাসিতার চেয়ে আখেরাতের সফলতাই একজন মানুষের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিৎ। সুতরাং পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১০৮) ।
পূর্বের আয়াতাবলীতে দুনিয়ার মোহে আসক্ত হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, আর অত্র আয়াতে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাব জুহাইলী: ৩/১৬৪) ।

আয়াত সংশ্লিষ্ট ঘটনা:
ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাজী (র.) অত্র আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট দুইটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন:
(ক) আবু হারেসা ইবনু আলক্বামাহ নামক খৃষ্টান তার ভাইয়ের ইসলাম গ্রহণের সংবাদ পেয়ে রোম স¤্রাট তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা ও সহায়সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়ার ভয়ে তাকে ইসলাম থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করে। এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সহ বিশ্বমানবতাকে সতর্ক করেছেন।
(খ) বদরের যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনার ইহুদিদেরকে সতর্ক করে দিলে তারা তাদের ধনসম্পদ, জনশক্তি এবং ক্ষমতার দাম্ভিকতা করে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদেরকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে সহ সকল মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৫৯) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে, মানুষের ভালোবাসাকে সরাসরি ছয় বস্তুর দিকে সম্বন্ধ করে “মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে নারী, সন্তানসন্তুত, রাশি রাশি সম্পদ, ইত্যাদির ভালোবাসায় সজ্জিত করা হয়েছে” না বলে ‘ভালোবাসা’ ও ছয়টি বস্তুর মধ্যে একটি ‘শাহওয়াত’ বা কামনাবাসনা শব্দটিকে যোগ করে “মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে নারী, সন্তানসন্তুত, রাশি রাশি সম্পদ ইত্যাদির প্রতি কামনাবাসনার ভালোবাসায় সজ্জিত করা হয়েছে” বলার কারণ কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, উল্লেখিত ছয়টি বস্তুকে ভালোবাসা দোষের নয়, বরং প্রশংসনীয়। অপরদিকে এগুলোর প্রতি অতিমাত্রায় আশক্ত হওয়া দোষের। এজন্য আল্লাহ তায়ালা প্রথম পদ্ধতি অবলম্বন না করে দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে মানবজাতিকে ছয়টি বস্তুর প্রতি এ ধরণের অতিমাত্রায় আসক্ত হওয়া থেকে সতর্ক করেছেন। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/১৪) ।

২। মানবজাতিকে ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি আসক্ত করে সজ্জিত করা হয়েছে, এখন প্রশ্ন হলো: কে সজ্জিত করেছেন, আল্লাহ নাকি শয়তান?
এ আয়াতাংশের সাথে আক্বীদার বিষয় সম্পৃক্ত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত মনে করেন, প্রথিবীর ভালোমন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, এমনকি মানুষের ভালোমন্দ সকল কর্মেরও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা।
অপরদিকে মোতাজিলা সম্প্রদায় মনে করেন, ভালো জিনিস ও কর্মের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আর মন্দ জিনিষ ও কর্মের সৃষ্টিকর্তা শয়তান। তারা আরো বলেন, মানুষ তার কর্মের সৃষ্টিকর্তা।
এখন প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাওয়া যাক, প্রায় সকল তাফসীর গ্রন্থে বলা হয়েছে, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষার জন্য সৃষ্টিগতভাবে মানবজাতিকে ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি আসক্ত করে তৈরি করেছেন। যেমন: অন্য একটি আয়াতে এসেছে:
(إِنَّا جَعَلْنا ما عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَها لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا) [سورة الكهف: ৭].
অর্থাৎ: “যা কিছু যমীনের বুকে আছে আমি তাকে অবশ্যই তার জন্যে শোভা বর্ধনকারী বানিয়েছি, যাতে তাদের আমি পরীক্ষা করতে পারি যে, তাদের কাজকর্মের দিক থেকে কে বেশী উত্তম” (সূরা কাহ্ফ: ৭) । অন্য আরেকটি আয়াতে এসেছে:
(كَذلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ) [سورة الأنعام: ১০৮].
অর্থাৎ: “এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের নিজেদের কার্যকলাপ সুশোভন করে রেখেছি” (সূরা আনয়াম: ১০৮) ।
আর শয়তান মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার জন্য উল্লেখিত ছয়টি বস্তুকে মানুষের সামনে সজ্জিত করে উপস্থাপন করে। যেমন: কোরআনের একটি আয়াতে এসেছে:
(وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ) [سورة الأنفال: ৪৮].
অর্থাৎ: “যখন শয়তান তাদের কাজগুলো তাদের সামনে খুব চাকচিক্যময় করে পেশ করেছিলো” (সূরা আনফাল: ৪৮) ।

৩। আয়াতের মৌলিক শিক্ষা হলো: কোন বস্তুকে ভালোবাসার দুইটি স্তর:
(ক) অপছন্দ করা সত্তেও কোন বস্তুকে ভালোবাসা। যেমন: একজন মুসলিম তার স্বভাবজাত কারণে কিছু হারাম বস্তুকে ভালোবাসে, কিন্তু সে খারাপ বস্তুটিকে ভালোবাসতে অপছন্দ করে। এ ধরণের ভালোবাসার জন্য কাউকে পাকড়াও করা হবে না।
(খ) কোন বস্তুকে পছন্দ করতে ভালোবাসা, যার ভিতর তিনটি স্তর একত্রে নিহীত থাকে: (ক) বস্তুকে ভালোবাসা, (খ) ঐ বস্তুর প্রতি কামনাবাসনাকে ভালোবাসা এবং (গ) এ ভালোবাসাকে কল্যানকর মনে করা। এটা ভালোবাসার চুড়ান্ত স্তর। এর দুইটি রুপ হতে পারে:
(র) বস্তুটির প্রতি কামনাবাসনার ভালোবাসা থাকাটা কল্যানকর, যেমন: সূরা স্বাদ এর ৩২ নাম্বার আয়াতে সোলাইমান (আ.) বলেছিলেন: আমি কল্যানকর বস্তুকে ভালোবাসতে পছন্দ করি। অর্থাৎ- আমি কল্যানকর বস্তুকে ভালো বাসি এবং সেটাকে ভালোবাসতে পছন্দ করি। এ ধরণের ভালোবাসা প্রশংসনীয়।
(রর) বস্তুটির প্রতি কামনাবাসনার ভালোবাসা থাকা অকল্যানকর, যেমন: সূরা আলে ইমরানের ১৪ নাম্বার আয়াতে যে ছয়টি বস্তুর কথা বলা হয়েছে। মানুষ যখন এ জাতিয় বস্তুর প্রতি এ পর্যায়ের ভালোবাসায় উপনিত হয়, তখন সে আল্লাহর একান্ত দয়া ছাড়া সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে না। এ ধরণের ভালোবাসা নিন্দনীয়। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৬১) ।

৪। এখন একটি প্রশ্ন হতে পারে, আয়াতে বর্ণিত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর প্রতি ভালোবাসা কখন বৈধ হয় এবং কখন অবৈধ হয়?
এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হলো- যখন উল্লেখিত বস্তুকে অর্জন করার পিছনে নি¤েœর উদ্দেশ্যগুলো পাওয়া যাবে, তখন তার প্রতি ভালোবাসা বৈধ হবে:
(ক) দ্বীনের কাজে ব্যবহার করা।
(খ) এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
(গ) অর্জিত হওয়ার পর তা শরিয়তের বিধান অনুযায়ী ব্যবহার করা।
এবং যখন উল্লেখিত বস্তুকে অর্জন করার পিছনে নি¤েœর উদ্দেশ্যগুলো পাওয়া যাবে, তখন তার প্রতি ভালোবাসা অবৈধ হবে:
(ক) দ্বীনের ক্ষতি সাধনের কাজে ব্যবহার করা।
(খ) এর মাধ্যমে দাম্ভিকতা পোষণ করা।
(গ) অর্জিত হওয়ার পর বেপড়োয়া হয়ে যাওয়া। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
উল্লেখিত প্রশ্নের বর্ণনামূলক উত্তর হলো:
নারী: প্রাপ্ত বয়স্কে উপণিত হওয়ার পর প্রত্যেক পুরুষের সব থেকে বেশী প্রয়োজন বোধ হয় একজন সঙ্গিনীর। নারীর প্রতি পুরুষের ভালোবাসা ইসলামী শরিয়তের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু শরয়ী বিধানকে পড়োয়া না করে তাদেরকে কেবল কামনাবাসনা, ভোগবিলাসিতা, যৌন চাহিদা, বেহায়াপনা ইত্যাদির জন্য ভালোবাসা হলে তা অবৈধ হবে।
সন্তানসন্ততি: মুসলিম জনশক্তি বৃদ্ধি, প্রজনন ধারা অব্যাহত রাখা, দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করা, আল্লাহর পথের সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলা, জনসেবায় পেশ করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তাদেরকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু পৃথিবীতে ক্ষমতা বাড়ানোর নেশা, ইসলাম বিরোধী জনশক্তি বৃদ্ধি, দাম্ভিকতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তাদেরকে ভালোবাসা নিন্দনীয়।
ধনসম্পদ: জীবন ধারণ করা, আত্মীয়দের সহযোগিতা করা, দানসদকা করা, দ্বীনের পথে ব্যয় করা, অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ধনসম্পদকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু দাম্ভিকতা, ইসলাম বিরোধী শক্তিকে শক্তিশালী করা, কেবল দুনিয়া নিয়ে মত্ত থাকা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ধনসম্পদকে ভালোবাসা অবৈধ।
ঘোড়া: আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং জিহাদের প্রস্তুতির জন্য ঘোড়াকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়, কিন্তু দাম্ভিকতার জন্য ভালোবাসা নিন্দনীয়।
চতুষ্পদ জন্তু: চাষাবাদ করা, বোঝা বহণের কাজ নেওয়া, জমি থেকে ফসলাদি উৎপন্ন করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ জন্তুকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু কেবল দুনিয়া অর্জন, দাম্ভিকতা, আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন হয়ে সুখ-স¦াচ্ছন্দ্যের জীবন নিয়ে মেতে থাকা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ জন্তুকে ভালোবাসা নিন্দনীয়।
শস্যক্ষেত: অন্যকে উপকার করার জন্য চাষাবাদ করার উদ্দেশ্যে শস্যক্ষেতকে ভালোবাসা প্রশংসনীয়। কিন্তু কেবল দুনিয়া অর্জন, দাম্ভিকতা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে শস্যক্ষেতকে ভালোবাসা নিন্দনীয়। (তাফসীর আল-মুনীর, ওয়াহাবা জুহাইলী: ৩/১৬৬-১৬৮) ।
উল্লেখিত আয়াতে, মূলত ছয়টি লোভনীয় বস্তুর কামনাবাসনায় মত্ত হয়ে মানুষ যেন আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে গিয়ে কেবল দুনিয়া অর্জন, দাম্ভিকতা, ভোগবিলাসিতা ইত্যাদিতে জড়িয়ে না পড়ে, তা থেকে সতর্ক করা হয়েছে।

আয়াতের আমল:
ছয়টি লোভনীয় বস্তু: নারী, সন্তানসন্ততি, ধনসম্পদ, ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু এবং শস্যক্ষেতকে কামনাবাসনার সাথে ভালোবাসা যাবে না। বরং কেবল দুনিয়া অর্জন এবং দাম্ভিকতাকে বাদ দিয়ে কেবল জীবন জীবিকার তাকিদে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এগুলোকে ভালোবাসা।

সূরা আলে-ইমরান এর (১০-১৩) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে অহংকারী কাফিরদের পরিণতি।

By দৈনিক তাফসীর 2 Comments

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَأُولَئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّارِ (10) كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ (11) قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ (12) قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِي فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُمْ مِثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَنْ يَشَاءُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِأُولِي الْأَبْصَارِ (13) [سورة آل عمران: 10-13]

 

আয়াতের আলোচ্যবিষয়: ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে অহংকারী কাফিরদের পরিণতি।

আয়াতের সরল অনুবাদ ও শব্দার্থ:
১০। নিশ্চয় যারা কুফরী করে, তাদের মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর নিকট কোন কাজে আসবে না এবং তারাই দোযখের ইন্ধন হবে।
১১। ফিরআউনের বংশধরগণ এবং তাদের পূর্ববর্তীগণের মতো, যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যপ্রতিপন্ন করেছিল। অতঃপর তাদের পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করেছিলেন। বস্তুত আল্লাহ শাস্তি প্রদানে অত্যন্ত কঠোর।
১২। হে আল্লাহর নবী! আপনি কাফিরদেরকে বলুন, তোমরা অচিরেই পরাজিত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে সমবেত করা হবে। আর সেটি কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল।
১৩। নিশ্চয় তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে দুইটি দলের মধ্যে, যারা পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দলটি কাফির। তারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ওদেরকে নিজেদের দ্বিগুণ দেখছিল। আর আল্লাহ নিজ সাহায্য দ্বারা যাকে চান তাকে শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা।

আয়াতের ভাবার্থ:
নাজরানের খৃষ্টান, মদীনার ইহুদী এবং মক্কার মুশরিক সহ সাড়া দুনিয়ায় কিয়ামত পর্যন্ত যারা আগমণ করবে, তাদের সকলের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: নিশ্চয় যারা আল্লাহর একাত্ববাদকে অস্বীকার করে, তাদের মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়া ও আখেরাতে কোথাও তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। যেমনিভাবে ফিরআউনের বংশধরগণ এবং তাদের পূর্ববর্তী আদ, সামূদ, কাওমে লূত ও আসহাবুল উখদূদ সহ অন্যান্য জাতি আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যপ্রতিপন্ন করে রক্ষা পায়নি। আল্লাহ তায়ালা পাপের কারণে তাদেরকে কঠিনভাবে পাকড়াও করেছিলেন। বস্তুত আল্লাহ শাস্তি প্রদানে অত্যন্ত কঠোর।
হে আল্লাহর নবী! ইহুদী এবং অন্যান্য কাফিরদের মধ্য থেকে যারা ‘বদর’ যুদ্ধের বিজয়কে কেন্দ্র করে মুসলমানদেরকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্ল করে, তাদেরকে বলুন, তোমরা অচিরেই দুনিয়াতে পরাজিত ও লাঞ্চিত হবে এবং কুফরির উপর মৃত্যুবরণ করার কারণে আখেরাতে জাহান্নামের মধ্যে সমবেত হবে। আর জাহান্নাম অত্যন্ত নিকৃষ্ট আবাসস্থল।
হে দাম্ভিক ইহুদী সম্প্রদায়! নিশ্চয় তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে দুইটি দলের মধ্যে, যারা ‘বদর’ যুদ্ধে পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। একটি দল মুমিন, যারা লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দল কাফির, যারা লড়াই করেছিল শয়তানের পথে। মুসলিম পক্ষকে শক্তিশালী করার জন্য আল্লাহ তায়ালা এমন একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করলেন, যার কারণে কাফির বাহিনী বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের ময়দানে তাদের প্রকৃত সংখ্যার দ্বিগুণ দেখছিল। ফলে, কাফির বাহিনী ভয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়েছিল। আর আল্লাহ নিজ সাহায্য দ্বারা যাকে চান তাকে শক্তিশালী করেন। নিশ্চয় এতে রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৯-২৯০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫১, আল-মুন্তাখাব: ১/৭১-৭২) ।

আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا) ‘নিশ্চয় যারা কাফির’, আয়াতাংশ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এ সম্পর্কে তিনটি মত পাওয়া যায়:
(ক) নাযরানের প্রতিনিধি দল এবং মদীনার ইহুদী, মুশরিক ও মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৯) ।
(খ) শুধু নাযরানের প্রতিনিধি দলকে বুঝানো হয়েছে। বিভিন্ন কাহিনী থেকে স্পষ্ট হয় যে, নাযরান প্রতিনিধি দলের একজন আবু হারিসা ইবনু আলক্বামা তার ভাইকে বলেছিলো: আমরা জানি মোহাম্মদ সত্য নবী, কিন্তু তা যদি প্রকাশ করি তাহলে রোম সম্রাট আমাদেরকে যে সহায় সম্পত্তি দিয়েছে তা আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা এখানে ঘোষণা করেছেন যে, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
(গ) ব্যাপকভাবে সকল কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে; কারণ আয়াতে ব্যাপক অর্থবোধক ‘যারা’ শব্দটি এসেছে। আর নিয়ম হলো: “আয়াত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা হবে শব্দের ব্যাপকতার ভিত্তিতে, অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট খাস হওয়ার ভিত্তিতে নয়”। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৭/১৫২) ।
তবে দুইটি কারণে তৃতীয় মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য:
(ক) এ অর্থটি ব্যাপক অর্থবোধক হওয়ার কারণে প্রথম দুইটি মতকেও অন্তর্ভূক্ত করে।
(খ) প্রায় সকল তাফসীর গ্রন্থেই তৃতীয় মতের আলোকে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

(قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا) ‘আপনি কাফেরদেরকে বলুন’, বার নাম্বারের অত্র আয়াতাংশে কাফের দ্বারা মদীনার ‘কাইনুকা’ গোত্রের ইহুদীদেরকে বুঝানো হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৯) । তবে এখানেও ব্যাপকার্থে সকল কাফেরদেরকে উদ্দেশ্য করা যেতে পারে।
(فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا) ‘দুইটি দল মুখোমুখি হয়েছিল’, এখানে দুইটি দল দ্বারা ‘মুসলিম’ এবং ‘কাফির’ দলকে বুঝানো হয়েছে, যারা বদরের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিল। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৯) ।
(يَرَوْنَهُمْ مِثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ) অত্র আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ হতে পারে:
(ক) বদর যুদ্ধে কাফির বাহিনী বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলিম বাহিনীকে মুসলমানদের প্রকৃত সংখ্যার দ্বিগুণ দেখেছিল। অর্থাৎ: প্রায় সাতশ দেখেছিল।
(খ) বদর যুদ্ধে কাফির বাহিনী বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলিম বাহিনীকে কাফিরদের প্রকৃত সংখ্যার দিগুণ দেখেছিল। অর্থাৎ: দুই হাজার দেখেছিল।
(গ) বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বাহ্যিক দৃষ্টিতে কাফির বাহিনীকে মুসলমানদের সংখ্যার দ্বিগুণ দেখেছিল। অর্থাৎ: প্রায় সতশ দেখেছিল। (তাফসীর আল-বাইযাভী: ২/৮)।
এখানে তৃতীয় মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য; কারণ এ মতের স্বপক্ষে সূরা আনফালে একটি আয়াত পাওয়া যায়, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَلْفٌ يَغْلِبُوا أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ اللَّهِ) [سورة الأنفال:৬৬].
অর্থাৎ: “অতএব তোমাদের মধ্যে যদি একশ’ ধৈর্যশীল মানুষ থাকে, তাহলে তারা দুশ’র উপর জয়ী হবে; আর যদি থাকে তোমাদের মধ্যে এক হাজার ধৈর্যশীল ব্যক্তি, তাহলে তারা আল্লাহর হুকুমে দু’হাজারের উপর বিজয়ী হবে” (সূরা আনফাল: ৬৬) ।
আয়াতের সাথে পূর্বের আয়াতের সম্পর্ক:
(১-৬) নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদের প্রমাণ এবং (৭-১০) নাম্বার আয়াতে যারা দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে ছলছাতরী পূর্বক ‘মুহকাম’ আয়াতকে বাদ দিয়ে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে গ্রহণ করে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। আর অত্র আয়াতসমূহে যারা একাত্ববাদকে অস্বীকার করবে এবং ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত নিয়ে ছলছাতরী করবে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের ভয়াবহ পরিণতির আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং অত্র আয়াতসমূহ পূর্বের আয়াতের পরিপূরক। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৫৯) ।

আয়াতে তাশবীহ বা উপমার ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো: অদৃশ্য বিষয়কে দৃশ্যমান বিষয়ের সাথে উপমা দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া। এখানেও (১০-১১) নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নাজরানের খৃষ্টানদেরকে ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী মিথ্যাচারী জাতির সাথে উপমা প্রদানের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন ফেরআউন ও পূর্ববর্তী পাপিষ্ট জাতির মতো নাজরানের খৃষ্টানদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিও আল্লাহর শাস্তি এসে গেলে কোন উপকারে আসবে না।
লক্ষনীয় যে, বালাগাতের পরিভাষায় একটি উপমাতে চারটি বিষয় থাকতে হয়: (ক) যাকে উপমা দেওয়া হয়, (খ) যার সাথে উপমা দেওয়া হয়, (গ) উপমা দেওয়ার হরফ এবং (ঘ) উপমার উদ্দেশ্য। বালাগাতের আলোকে (১০-১১) আয়াতে বর্ণিত উপমার দুইটি ব্যখ্যা করা যায়:
এক নাম্বার ব্যাখ্যা হলো:
 যাকে উপমা দেওয়া হয়েছে: নাজরানের খৃষ্টানগণ।
 যার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে: ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতি।
 উপমা প্রদানের হরফ: (كَ) ‘কা’ (মত)।
 উপমা প্রদানের উদ্দেশ্য: আল্লাহর শাস্তি এসে গেলে ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে না আসা।
অর্থাৎ: আল্লাহর শাস্তি এসে গেলে ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে না আসার দৃষ্টিকোন থেকে নাজরানের খৃষ্টানদের উদাহরণ ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতির মতো। ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতিকে যেমন তাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেনি, তেমনিভাবে নাজরানের খৃষ্টানদেরকেও তাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন) ।

দুই নাম্বার ব্যাখ্যা হলো:
 যাকে উপমা দেওয়া হয়েছে: নাজরানের খৃষ্টানগণ।
 যার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে: ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতি।
 উপমা প্রদানের হরফ: (كَ) ‘কা’ (মত)।
 উপমা প্রদানের উদ্দেশ্য: ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে অহংকার করা।
অর্থাৎ: ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে অহংকার করার দৃষ্টিকোন থেকে নাজরানের খৃষ্টানদের উদাহরণ ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতির মতো। ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতি যেমন তাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি নিয়ে অহংকার করতো, তেমনিভাবে নাজরানের খৃষ্টানরাও তাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে অহংকার করতো। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন) ।

তিন নাম্বার ব্যাখ্যা হলো:
ইমাম ওহাবা জুহাইলী (র.) তার তাফসীর গ্রন্থে তাশবীহ এর আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
 যাকে উপমা দেওয়া হয়েছে: নাজরানের খৃষ্টানগণ।
 যার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে: ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতি।
 উপমা প্রদানের হরফ: (كَ) ‘কা’ (মত)।
 উপমা প্রদানের উদ্দেশ্য: মোহাম্মদ (সা.) ও আল্লাহর আয়াতাবলীকে অস্বীকার করা।
অর্থাৎ: মোহাম্মদ (সা.) ও আল্লাহর আয়াতাবলীকে অস্বীকার করার দৃষ্টিকোন থেকে নাজরানের খৃষ্টান অধিবাসীর উদাহরণ ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতির মতো। ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী আদ, সামূদ ইত্যাদি জাতি যেমন মুসা (আ.) ও আল্লাহ আয়াতাবলীকে অস্বীকার করতো, তেমনিভাবে নাজরানের খৃষ্টানরাও মোহাম্ম (সা.) ও আল্লাহর আয়াতাবলীকে অস্বীকার করতো। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন) ।

(১১-১২) নাম্বার আয়াত সংশ্লিষ্ট ঘটনা ও অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধে বিজয়ের পর মদীনায় ফিরে ইহুদীদেরকে কায়নুকা গোত্রের একটি বাজারে জড়ো করে সবার উদ্দেশ্যে বললেন: হে ইহুদী সম্প্রদায়, কোরাইশদের মতো পরাজিত হওয়ার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করো। এর জবাবে ইহুদীরা বললো: হে মোহাম্মদ, অনবিজ্ঞ কোরাইশ, যারা যুদ্ধ জানে না, তাদেরকে হারিয়ে তুমি এক ধরণের ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ে গেছো। আল্লাহর কসম করে বলছি, তুমি যদি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, তাহলে বুঝতে আমরা কারা। আর আমাদেরকে নিয়ে এ ধরণের মন্তব্য করতে সাহস করতে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা ১১ এবং ১২ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করে ইহুদীদের ঘৃণ্য মন্তব্যের উত্তর রাসূলুল্লাহ (সা.) কে শিক্ষা দিয়েছেন। (লুবাব আল-নুক‚ল: ৬০-৬১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। দশ নাম্বার আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, মানুষ আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হওয়ার মূল কারণ হলো: কুফরী ও আল্লাহর আবাধ্যতা। আর আল্লাহ তায়ালা যখন কাফিরদেরকে পাকড়াও করতে চান, তখন তদের ক্ষমতা, ধনসম্পদ, সন্তানসন্তুত ইত্যাদি তাদেরকে কোন উপকার করতে পারে না (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/২৯১)। যেমন: সূরা তাওবা এর ৮৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
﴿وَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَأَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ﴾ [سورة التوبة: ৮৫].
অর্থাৎ: “ওদের ধনসম্পদ এবং সন্তানসন্তুত যেন আপনাকে বিমুগ্ধ করতে না পারে; মূলত আল্লাহ তায়ালা এগুলোর মাধ্যমে তাদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিতে চান এবং এমন এক অবস্থায় তাদের আত্মা বের হবে, যখন তারা পুরোপুরি কাফের থাকবে” (সূরা তাওবা: ৮৫) ।
এছাড়াও কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে দেখতে পাই কাফিররা যখন ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুত নিয়ে অহংকার করেছে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুত তাদেরকে তাঁর নৈকট্য লাভে মোটেই সহায়ক হবে না, বরং ঈমান ও সৎআমলই তাঁর নৈকট্য লাভ করাতে পারে। যেমন: সূরা সাবা এর (৩৫-৩৭) নাম্বার আয়াতে এসেছে:
﴿وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ (৩৫) قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ (৩৬) وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِي تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفَى إِلَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوا وَهُمْ فِي الْغُرُفَاتِ آمِنُونَ (৩৭)﴾ [سورة سبأ: ৩৫-৩৭].
অর্থাৎ: “তারা আরো বলে, আমরা এ দুনিয়াতে ধনে জনে অধিকতর সমৃদ্ধশালী, সুতরাং পরকালে আমাদেরকে কোন আযাব দেওয়া হবে না। হে নবী, আপনি ওদেরকে বলে দিন, আমার রব যাকে ইচ্ছা করেন তার রিযক প্রশস্ত করে দেন, যাকে ইচ্ছা সংকুচিত করে দেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এটা জানে না। তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুত এমন কিছু নয় যে এর মাধ্যমে তোমরা আমার নৈকট্য লাভ করবে। তবে, যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে এবং নেকআমল করেছে, তাদের জন্য কিয়ামতে দিগুণ পুরস্কার রয়েছে। তারা তাদের নেকআমলের কারণে জান্নাতের বালাখানায় নিরাপদে অবস্থান করবে” (সূরা সাবা: ৩৫-৩৭) ।

২। দশ নাম্বার আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সমসাময়ীক নাজরানের কাফেরদের অপরাধের কারণে তাদের উপর সংঘঠিত শাস্তির বর্ণনার পর এগার নাম্বার আয়াতে ফেরআউন সম্প্রদায় এবং তার পূর্বের আদ, সামূদ, আসাহাবুল আইকা, আসহাবুল মুতাফিকাত, আসহাবুর রাস্স ইত্যাদি কাফের সম্প্রদায়ের উপর শাস্তির বর্ণনা প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা একটি চিরন্তন নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন, আর তা হলো: “অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি পাবেই, সে যে যুগের অথবা যে গোত্রেরই হোক না কেন” (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/১৬৩)। এর মাধ্যমে আল্লাহ মক্কার কোরাইশ গোত্র সহ সমগ্র মানব জাতিকে সতর্ক করেছেন যে, তারাও অপরাধ করলে শাস্তি পাবেই। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
একই কথা আল্লাহ তায়ালা সূরা আনফাল এর (৫১-৫৪) আয়াতে দুই বার বর্ণনা করেছেন:
﴿ذَلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ (৫১) كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ شَدِيدُ الْعِقَابِ (৫২) ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَى قَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (৫৩) كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُمْ بِذُنُوبِهِمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ وَكُلٌّ كَانُوا ظَالِمِينَ (৫৪)﴾ [سورة الأنفال: ৫১-৫৪].
অর্থাৎ: “আসলে এটা হচ্ছে তোমাদের হাতের কামাই, আল্লাহ তায়ালা কখনও তাঁর বান্দার উপর যুলম করেন না। এরা ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মতোই, তারা আল্লাহর আয়াতাবলীকে অস্বীকার করেছে, ফলে তাদের অপরাধের দরুন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পাকড়াও করলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শক্তিশালী, কঠোর শাস্তিদানকারী। এটা এ কারণে যে, আল্লাহ তায়ালা কোন কাওম থেকে তাঁর প্রদত্ত নেয়ামত ছিনিয়ে নেন না, যতোক্ষণ না তারা অপরাধে জড়িয়ে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সবকিছু শুনেন, জানেন। এরা ফেরআউন এবং তার পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মতোই, যারা তাদের মালিকের আয়াতাবলীকে অস্বীকার করেছে, অতঃপর আমি তাদের অপরাধের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম এবং ফেরআউন সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে দিয়েছি, মূলত তারা সবাই যালেম ছিলো” (সূরা আনফাল: ৫১-৫৪) ।

৩। বার এবং তের নাম্বার আয়াতে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ ‘গাযওয়ায়ে বদর’ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অত্র আয়াতদ্বয়ে কয়েকটি বিষয় ফুটে উঠে:
(ক) বদরের যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে প্রতিশ্রæতি এবং সংবাদ দিয়েছিলেন যে, এ যুদ্ধে কাফিররা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় লাভ করবে। এ সম্পর্কে ওমর ইবনু খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত ‘সহীহ মুসলিম’ এ একটি হাদীস এসেছে:
“جَعَلَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يُرِينَا مَصَارِعَ الْقَوْمِ لَيْلَةَ بَدْرٍ، هَذَا مَصْرَعُ فُلَانٍ غَدًا إِنْ شَاءَ اللَّهُ، وَهَذَا مَصْرَعُ فُلَانٍ غَدًا إِنْ شَاءَ اللَّهُ، فَمَا أَمَاطَ أَحَدٌ مِنْهُمْ عَنِ الْمَصْرَعِ الَّذِي قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ” (مسند البزار: ২২২).
অর্থাৎ: “রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধের আগের রাতে আমাদেরকে কোরাইশ গোত্রের যোদ্ধাদের ধরাশায়ী হয়ে কতল হওয়ার জায়গাগুলো এভাবে দেখালেন যে, আল্লাহর ইচ্ছায় আগামীকাল অমুকের মৃত্যু এখানে হবে এবং অমুকের মৃত্যু ওখানে হবে। (রাভী ওমার (রা.) বলেন) রাসূলুল্লাহ (সা.) যার মৃত্যুর যে জায়গার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বদরের যুদ্ধে তার মৃত্যু সেখানেই হয়েছে” (মুসনাদে বাজ্জার: ২২২) ।
(খ) মক্কার মুশরিকরা বদর যুদ্ধে যেমন চরমভাবে পরাজিত হয়েছে, তেমনিভাবে আখেরাতেও তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট আবাসস্থল জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
(গ) বদর যুদ্ধ দুই দলের মধ্যে সংগঠিত হয়েছে: একদল মুসলিম, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছে এবং আরেকদল কাফির, যারা শয়তানের পথে যুদ্ধ করেছে।
(ঘ) আল্লাহ তায়ালা বদরের যুদ্ধে মুসলমানদেরকে সরাসরি সাহায্য করেছেন। মূলত বদরের যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩১৩ জন এবং কাফেরদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১০০০, যা মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যার তিনগুন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশেষ কুদরাতে যুদ্ধক্ষেত্রে কাফেরদের সংখ্যাকে মুসলমানের চোখে তাদের (মুসলমানদের) সংখ্যার দ্বিগুণ দেখিয়েছেন, অপরদিকে মুসলমানদের সংখ্যাকে কাফেরদের চোখে তাদের (কাফিরদের) সংখ্যার দ্বিগুণ দেখিয়েছেন। এ সম্পর্কে সূরা আনফালের অনেকগুলো আয়াতের মধ্যে একটি হলো:
﴿وَإِذْ يُرِيكُمُوهُمْ إِذِ الْتَقَيْتُمْ فِي أَعْيُنِكُمْ قَلِيلًا وَيُقَلِّلُكُمْ فِي أَعْيُنِهِمْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ﴾ [سورة الأنفال: ৪৪].
অর্থাৎ: “স্মরণ করো, যখন তোমরা যুদ্ধের ময়দানে তাদের সামনাসামনি হলে, তখন আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চোখে তাদের সংখ্যাকে কম করে দেখালেন এবং যুদ্ধের পূর্বে তাদের চোখে তিনি তোমাদের সংখ্যা দেখালেন কম, যেন আল্লাহ তায়ালা তাই ঘটিয়ে দেখান যা কিছু তিনি ঘটাতে চান; মূলত আল্লাহ তায়ালার দিকেই সব কিছু প্রত্যাবর্তিত হবে” (সূরা আনফাল: ৪৪) ।
উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ওহাবা জুহাইলী (র.) বলেন: আল্লাহ যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের চোখে কাফেরদের সংখ্যাকে কম করে দেখালেন। কাফেরদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে ধরাশায়ী করানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের পূর্বে কাফেরদের চোখে মুসলমানদের সংখ্যা কম করে দেখালেন এবং যখন তারা যুদ্ধে অবতরণ করলো, তখন মুসলমানদের সংখ্যাকে কাফেরদের চোখে বাড়িয়ে দেখালেন, যা সূরা আলে ইমরানের তের নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়। (তাফসীর আল-মুনীর: ১০/১৬) ।
(ঙ) যুদ্ধের বিজয় বাহ্যিক সংখ্যা ও ক্ষমতার আধিক্য দিয়ে হয় না, বরং যুদ্ধের বিজয় হয় আল্লাহর প্রতি ঈমানের দৃঢ়তা এবং তাঁর সাহায্যের ভিত্তিতে। বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের পক্ষে বিজয় দান করেছেন দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। যেমন: সূরা মোহাম্মদ এ আল্লাহ বলেন:
﴿يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدامَكُمْ﴾ [سورة محمد: ৭].
অর্থাৎ: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে আল্লাহকে সহযোগিতা, তাহলে তিনিও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তিনি তোমাদের তোমাদের পা-সমূহকে সুদৃঢ় রাখবেন” (সূরা মোহাম্মদ: ৭) ।
এ সম্পর্কে আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ﴾ [سورة الروم: ৪৭].
অর্থাৎ: “ঈমানদারদের সাহায্য করা আমার উপর কর্তব্য” (সূরা রূম: ৪৭) ।
(চ) উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে এমন দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়, যা কোরআন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত হওয়ার প্রমাণ বহণ করে:
(র) বদরের যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে মুসলমানদের পক্ষে বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান করা, যা মানুষের স্বাভাবিক রীতিনীতির বিপরীত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বদরের যুদ্ধের পূর্বের রাতে সাহাবাদেরকে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, যার আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে।
(রর) আল্লাহ তায়ালার বিশেষ সাহায্যে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম যোদ্ধা বেশী সংখ্যক কাফির যোদ্ধার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/২৯১/ তাফসীর আল-মুনীর, ওহাবা জুহাইলী: ৩/১৬৩) ।
(ছ) তের নাম্বার আয়াতের শেষাংশ থেকে বুঝা যায়, বদরের যুদ্ধের মতো যুগান্তকারী ঘটনা থেকে সবাই শিক্ষা গ্রহণ করবে না। যারা তাকওয়া ভিত্তিক জ্ঞানে গুণান্বিত, কেবল তারাই তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।

৪। উল্লেখিত আয়াতাবলী থেকে বর্তমান যুগের ইসলামী দলগুলোর জন্য অন্যতম একটি শিক্ষা হলো: বিজয়ের জন্য ঈমান ও ইসলামের বিধানের উপর দৃঢ়ভাবে অবস্থানপূর্বক আল্লাহর উপর ভরসা করা। আমাদের সমাজে দেখা যায় কিছু কিছু ইসলামী দল বিজয় লাভের কর্মপদ্ধতি হিসেবে ইসলামী বিধানে একটু কমবেশ করে একটি বাতিল শক্তির সাথে সমঝোতা করে, যতসব বেপরোয়া কর্মসূচী দিয়ে সমাজকে অস্থির করে তুলে। অথচ কোরআনের আয়াত থেকে বুঝা যায়, বিজয় লাভের অন্যতম শর্ত হলো: সাচ্চা ঈমান এবং আল্লাহর উপর ভরসা। আর এ পদ্ধতি অবলম্ভন করেই যুগে যুগে ইসলামের পক্ষে বিজয় এসেছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ধনসম্পদ, সন্তানসন্তুত এবং ক্ষমতা নিয়ে বড়াই না করা।
(খ) ধনসম্পদ, সন্তানসন্তুত এবং ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার শাস্তি থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারে না, এ কথা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করা।
(গ) অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি পাবেই, এ কথা বিশ্বাস করে দৈনন্দিন জীবনযাপন করা।
(ঘ) বিজয়ের জন্য বাহ্যিক ক্ষমতা ও সংখ্যাধিক্যের উপর নির্ভর না করে, সঠিক পথে থেকে আল্লাহর উপর ভরসা করা।

সূরা আলে-ইমরান এর (৭-৯) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: কোরআনে ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ (7) رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ (8) رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ (9) [سورة آل عمران: 7-9]

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: কোরআনে মুহকাম এবং মুতাশাবিহ্ আয়াত।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭। তিনিই তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন, তার মধ্যে আছে মুহকাম আয়াতসমূহ। সেগুলো কিতাবের মূল আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ্। ফলে, যাদের ক্বলবে বক্রতা আছে, তারা ফিতনা সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহ্ আয়াতের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত। বস্তুত বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে।
৮। হে আমাদের রব! আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বলবকে বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।
৯। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি একদিন মানবজাতিকে শমবেত করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। (আল-বায়ান ফাউন্ডেশন এবং তাফসীর আহসানুল বায়ান) ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
পূর্ববর্তী আয়াতের ধারাবাহিকতায় অত্র আয়াতসমূহেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর একাত্ববাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলছেন, তিনি এমন একক সত্বা যিনি মোহাম্মদ (সা.) এর উপর এমন কিতাব নাযিল করেছেন, যার আয়াতসমূহ দুই ভাগে বিভক্ত:
(ক) মুহকাম: এমন আয়াত যার অর্থ খুবই স্পষ্ট, যাতে দ্বিতীয় কোন অর্থের সম্ভাবনা থাকে না। এই আয়াতগুলোতে সাধারণত ফারায়েজের বিধান, আক্বায়েদ, ইবাদত, আদেশ-নিষেধ এবং হালাল-হারামের বর্ণনা এসেছে। এগুলো হলো কিতাবের মূল, কোন বিষয়ে মতবিরোধ হলে এর দিকে ফিরতে হবে।
(খ) মুতাশাবিহ: এমন আয়াত যার একাধিক অর্থ থাকে, যার বাহ্যিক অর্থ যে অর্থ উদ্দেশ্য করা হয়েছে তার বিপরীত এবং তার অর্থ বাহ্যিকভাবে কখনও মুহকাম আয়াতের অনুকুলে হয় আবার কখনও বিপরীত হয়।
একারণে, যাদের ক্বলবে বক্রতা আছে, তারা ফিতনা সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে ‘মুতাশাবিহ্’ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে থাকে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত। বস্তুত বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে।
আর জ্ঞানবান মানুষরা ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে তাওফীকের প্রত্যাশায় দুইটি দোয়া করেন:
(ক) হে আমাদের রব! আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বলবকে বক্র করবেন না এবং এ আয়াতগুলো বুঝার ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।
(খ) হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি একদিন মানবজাতিকে সমবেত করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৫৩-১৫৪, আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৭, তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫০) ।

আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(الْكِتَابَ) ‘আল-কিতাব’, আয়াতাংশ দ্বারা ‘কোরআন মাজীদ’ কে বুঝানো হয়েছে।

(مُحْكَمَاتٌ) ‘মুহকামাত’, আয়াতে ‘মুহকাম’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে তাফসীরকারকদের থেকে আটটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ‘মুহকাম’ দ্বারা ‘নাসিখ’ বা রহিতকারী আয়াতসমূহকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
(খ) ‘হালাল-হারাম’ সংশ্লিষ্ট আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(গ) যে সকল আয়াতের ব্যাখ্যা আলেমগণ জানেন, সে সকল আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(ঘ) যে সকল আয়াত রহিত হয় নাই, সে সকল আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(ঙ) কোরআন মাজীদের ঐ সকল শব্দকে বুঝানো হয়েছে, যা বারবার আসেনি।
(চ) যে সকল আয়াত এতই স্পষ্ট যে তা বুঝতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না।
(ছ) হুরুফে মুকাত্বায়াত ছাড়া কোরআনের সকল আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(জ) আদেশ-নিষেধ, হালাল-হারাম এবং ওয়াদা-সতর্কতা সম্পর্কিত আয়াত। (যাদ আল-মাসীর, ইবনু আল-জাওযী: ১/২৫৮) ।
ইমাম নাহহাস (র.) বলেন: ‘মুহকাম’ হলো ঐ সকল আয়াত যা সয়ং স্পষ্ট এবং পাঠকের কাছেও স্পষ্ট। আর ‘মুতাশাবিহ’ হলো ঐ সকল আয়াত যা সয়ং অস্পষ্ট এবং পাঠকের কাছেও অস্পষ্ট। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/১১) ।

(أُمُّ الْكِتَابِ) ‘কিতাবের মা’, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস এবং ইবনু জুবাইরের ভাষ্যমতে এখানে আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘কিতাবের মূল’। (যাদ আল-মাসীর, ইবনু জাওযী: ১/২৫৮) । সুতরাং কোন বিধান বুঝতে, হালাল-হারামের পার্থক্য করতে, কোন বিষয়ের বিরোধ মিটাতে এবং অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝতে ‘মুহকাম’ আয়াতের দিকে ফিরতে হবে। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/২৮) ।

(مُتَشَابِهَاتٌ) ‘মুতাশাবিহাত’, আয়াতে ‘মুতাশাবিহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে তাফসীরকারকদের থেকে সাতটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ‘মুতাশাবিহ’ দ্বারা ‘মানসূখ’ বা রহিত হয়ে যাওয়া আয়াতসমূহকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
(খ) এমন আয়াত যার তাফসীর জানার কোন পথ নেই।
(গ) ‘মুতাশাবিহ’ হলো হুরূফ মোকাত্বায়াত।
(ঘ) ‘মুতাশাবিহ’ হলো এমন আয়াত যার অর্থ অন্য অর্থের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
(ঙ) ‘মুতাশাবিহ’ দ্বারা ঐ সকল শব্দকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যা কোরআনে বারবার এসেছে।
(চ) যে সকল আয়াত বুঝতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার হয়।
(ছ) ‘মুতাশাবিহ’ হলো: কোরআনে বর্ণিত ঘটনা এবং উদাহরণ। (যাদ আল-মাসীর, ইবনু আল-জাওযী: ১/২৫৯) ।

(زَيْغٌ) ‘বক্রতা’, আয়াতাংশের অর্থ কি? এ সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন: এর অর্থ হলো: কোন এক দিকে ঝুকে পড়া। এর আরেকটি অর্থ হলো: ‘মূল উদ্দেশ্যকে ছেড়ে দেওয়া’। (তাফসীরে কুরতুবী: ৪/১৩) । কামেলা আল-কাওয়ারী বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সত্য থেকে বিপরীত দিকে ঝুকে পড়া। (তাফসীর গরীব আল-কুরআন: ৩/৭) ।

(الْفِتْنَةِ) ‘ফিতনা’, অত্র শব্দটির মূল অর্থ হলো: ‘দুর্বল গুণের স্বর্ণকে তার ভালো গুণ দেখাতে আগুনে জালানো’। তবে আয়াতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: বিভ্রান্ত করা বা সত্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগানো। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/৩০) ।

(ابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ) ‘তার ব্যাখ্যার সন্ধানে’, আয়াতাংশ দ্বারা কয়েকটি উদ্দেশ্য হতে পারে:
(ক) ‘মুতাশাবিহ আয়াতকে নিজের বাতিল দলের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা পেশ করা’। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫০) ।
(খ) ‘মুতাশাবিহ আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করা’। (আল-মোন্তাখাব: ১/৭১) ।
(গ) আবু বকর আল-জাযায়েরী (র.) বলেন: নিজের ভ্রান্ত আক্বীদাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুতাশাবিহ আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করা’। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৬) ।

উল্লেখিত আয়াতবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলী তথা (১-৬) নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালার একাত্বাবাদের স্বপক্ষে চারটি দলীল পেশ করা হয়েছে। অত্র আয়াতাবলী তথা (৭-৯) নাম্বার আয়াতেও তাঁর একাত্ববাদের স্বপক্ষে দলীল বর্ণনার পাশাপাশি যারা তাঁর একাত্ববাদকে অস্বীকার করার লক্ষ্যে কোরআনের আয়াতকে অপব্যাখ্যাপূর্বক দলীল পেশ করবে তাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সূতরাং পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন)।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। সাত নাম্বার আয়াতে আল্লাহ কোরআনের আয়াতাবলীকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন:
(ক) মুহকাম আয়াত, এ ধরণের আয়াতের একটি মাত্র অর্থ থাকে এবং তা এতই স্পষ্ট যে বুঝতে কোন ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না।
(খ) মুতাশাবিহ আয়াত, এ ধরণের আয়াতে একাধিক অর্থ থাকে এবং তা অত্যাধিক অস্পষ্টতার কারণে বুঝতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার হয়।
দ্বিতীয় প্রকার আয়াত বুঝে না আসলে প্রথম প্রকার আয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
এখানে একটি উহ্য প্রশ্ন হতে পারে যে উল্লেখিত আয়াতে কোরানের আয়াতাবলীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’, কিন্তু সূরা হুদ এর প্রথম আয়াতে দেখতে পাই আল্লাহ পুরো কোরআনকে ‘মুহকাম’ বলেছেন: (كِتابٌ أُحْكِمَتْ آياتُهُ) [سورة هود: ১]. অর্থাৎ: “এ কোরআন হচ্ছে এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহ স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে” (সূরা হুদ: ১) । এবং সূরা যুমার এর তেইশ নাম্বার আয়াতে পুরো কোরআনকে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত বলেছেন: (اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتاباً مُتَشابِهاً) [سورة الزمر: ২৩]. অর্থাৎ: “আল্লাহ তায়ালা সর্বোৎকৃষ্ট বাণী নাযিল করেছেন, তা এমন কিতাব যার প্রতিটি বাণী পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যশীল” (সূরা যুমার: ২৩) । এখন এর মধ্যকার সমাধান কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে তাফসীরকারকগণ বলেন: ‘সূরা হুদ’ এর আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: কোরআন ভাষাশৈলীর এক উন্নত শিখরে আরোহণ করার কারণে তা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত , প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং তার বর্ণনা খুবই স্পষ্ট। এবং সূরা যুমার এর আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: কোরআনের বর্ণনা ভঙ্গি এতই উচ্চ মানের যে তার একাংশ আরেক অংশের সাথে অর্থের দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৫২) ।

২। যারা নিজের মত, দল, ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদির পক্ষে দলীল পেশ করার জন্য বহু অর্থযুক্ত ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত থেকে নিজেদের সুবিধামত অর্থটিকে গ্রহণ করে তাদের জন্য সাত নাম্বার আয়াতের শেষাংশে সতর্ক বার্তা রয়েছে। মূলতঃ খৃষ্টানরা ‘মুহকাম’ আয়াতকে বাদ দিয়ে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দ্বারা ঈসা (আ.) কে আল্লাহর রুহ এবং পুত্র সাব্যস্ত করলে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের জবাব দেন। যেমন: ‘সূরা যুখরুফ’ এর ৫৯ নাম্বার ‘মুহকাম’ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে:
(إِنْ هُوَ إِلَّا عَبْدٌ أَنْعَمْنَا عَلَيْهِ وَجَعَلْنَاهُ مَثَلًا لِبَنِي إِسْرَائِيلَ) [سورة الزخرف: ৫৯].
অর্থাৎ: “মূলত সে (ঈসা) ছিলো আমারই একজন বান্দা, যার উপর আমি অনুগ্রহ করেছিলাম” (সূরা যুখরুফ: ৫৯) । এবং ‘সূরা নিসা’ এর ১৭২নং ‘মুহকাম’ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে:
(لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ) [سورة النساء : ১৭২].
অর্থাৎ: “ঈসা নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরিচয় দিতে কখনও লজ্জাবোধ করেনি এবং আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতারাও এ বিষয়ে লজ্জাবোধ করেনি” (সূরা নিসা: ১৭২)।
খৃষ্টানরা উল্লেখিত দুইটি সহ অসংখ্য ‘মুহকাম’ আয়াতকে পাশ কাটিয়ে ঈসা (আ.) আল্লাহর রুহ হওয়ার ব্যাপারে ‘সূরা নিসা’ এর নি¤েœর ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছে:
(إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ) [سورة النساء: ১৭১].
অর্থাৎ: “মারইয়ামের পুত্র ঈসা ছিলো আল্লাহ রাসূল ও তাঁর বাণী, যা তিনি মারইয়ামের ওপর প্রেরণ করেছেন এবং সে ছিলো আল্লাহ কাছ থেকে পাঠানো এক ‘রূহ’” (সূরা নিসা: ১৭১)।
আমাদের সমাজেও কিছু সুযোগ সন্ধানী এবং দুনিয়াবী স্বার্থান্বেষী নামধারী আলেম ‘মুহকাম’ আয়াতকে বাদ দিয়ে বহু অর্থযুক্ত ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত থেকে নিজেদের সুবিধামত অর্থ গ্রহণ করে নিজের দল ও মতের স্বপক্ষে দলীল পেশ করে থাকে। যেমন: রাসূলুল্লাহ (সা.) মাটির তৈরি একজন মহা মানব এর স্বপক্ষে অনেকগুলো ‘মুহকাম’ আয়াতের মধ্যে অন্যতম হলো ‘সূরা কাহ্ফ’ এর ১১০ এবং ‘সূরা ফুসসিলাত’ এর ৬ নাম্বার আয়াত, যেখানে বলা হয়েছে:
(قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ) [سور الكهف: ১১০/ سورة فصلت: ৬].
অর্থাৎ: “হে নবী! তুমি বলো, আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ, তবে আমার উপর ওহী নাযিল হয়, আর সে ওহীর মূল কথা হচ্ছে তোমাদের মাবুদ হচ্ছে একজন” (সূরা কাহ্ফ: ১১০/ সূরা ফুসসিলাত: ৬) ।
একদল নামধারী আলেম উল্লেখিত ‘মুহকাম’ আয়াতকে পাশ কাটিয়ে ‘সূরা মায়িদা’ এর ১৫ নাম্বার ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দ্বারা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নুরের তৈরি সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে, যেখানে বলা হয়েছে:
(قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ) [سورة المائدة: ১৫].
অর্থাৎ: “অবশ্যই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আলোকবার্তিকা এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসে গেছে” (সূরা মায়িদা: ১৫) ।
অথচ নিয়ম হলো: কোন বিধান বুঝতে, হালাল-হারামের পার্থক্য করতে, কোন বিষয়ের বিরোধ মিটাতে এবং অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝতে ‘মুহকাম’ আয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/২৮) ।

৩। একটি উহ্য প্রশ্ন ও তার উত্তর: যদি ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দিয়ে কোন মাসয়ালা সাব্যস্ত হওয়া নিয়ে মতবিরোধ হয় এবং একই বিষয়ে কোন ‘মুহকাম’ আয়াত পাওয়া যায়, তখন করণীয় কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে সয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের বিপরীতে কোন ‘মুহকাম’ আয়াত পাওয়া গেলে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে তার জায়গায় রেখে তার প্রতি ঈমান আনয়ন পূর্বক ‘মুহকাম’ আয়াতের উপর আমল করতে হবে। যেমন: একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِي شُعَيْبٍ، قَالَ: خَرَجَ مِنْ وَرَاءِ حُجْرَاتِ رَسُولِ الله -صلى الله عليه وسلم- قَوْمٌ يُجَادِلُونَ بِالْقُرْآنِ، فَخَرَجَ مُحْمَرَّةٌ وَجْنَتَاهُ كَأَنَّمَا يَقْطِرَانِ دَمًا فَقَالَ: “يَا قَوْمِ لَا تُجَادِلُوا بِالْقُرْآنِ، فَإِنَّمَا ضَلَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِجِدَالِهِمْ إِنَّ الْقُرْآنَ لَمْ يَنْزِلْ لَيُكَذِّبَ بَعْضُهُ بَعْضًا، وَلَكِنْ نَزَلَ لَيُصَدِّقَ بَعْضُهُ بَعْضًا، فَمَا كَانَ مِنْ مْحُكَمِهِ فَاعْمَلُوا بِهِ، وَمَا كَانَ مِنْ مُتَشَابِهِهِ فَآمِنُوا بِهِ” (بغية الباحث عن زوائد مسند الحارث: ৭৩৫).
অর্থাৎ: “আবু শুয়াইব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হুজরা মোবারকের পিছনে কিছু লোক কোরআনের আয়াত নিয়ে মতবিরোধ করছিলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তা শুনে এমনভাবে রাগন্বিত হয়ে বের হয়েছিলেন যে তার দুই গাল লাল রং ধারণ করছিল আর মনে হচ্ছিলো রক্তের ফোটা গড়িয়ে পড়ছে। অতঃপর বললেন: হে লোকসকল! তোমরা কোরআন নিয়ে মতবিরোধ করো না, নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি মতবিরোধ করে ধ্বংস হয়েছে। জেনে রেখো, কোরআনের একাংশকে অপর অংশ দ্বারা মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার জন্য তা অবতীর্ণ হয়নি, বরং একাংশকে অপরাংশ দ্বারা সত্যায়িত করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং ‘মুহকাম’ আয়াতের আমল করো এবং ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করো”। (বুগইয়াতুল হারিস আন যাওয়ায়েদ মুসনাদ আল-হারিস: ৭৩৫)।

৪। আরেকটি উহ্য প্রশ্ন ও তার উত্তর, এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন কোরআনের ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা সকলে জানেন কি না? এর উত্তর হলো: ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত তিন প্রকার:
(ক) এমন আয়াত যার ব্যাখ্যা আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মাধ্যমে যতটুকু জানিয়েছেন তার চেয়ে বেশী দুনিয়ার কোন মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না। যেমন: আল্লাহর জাতের জ্ঞান, তাঁর গুণের হাকীকাত, কিয়ামতের জ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কিত আয়াত।
(খ) এমন আয়াত যার ব্যাখ্যা একটু চিন্তা গবেষণা ও অধ্যায়নের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। আরবী ভাষা এবং ব্যাকরণগত কারণে আয়াতের মধ্যে যে অস্পষ্টতা তৈরি হয়। যেমন: ব্যাকরণগত কারণে আয়াতের মধ্যে শব্দ আগে পরে হওয়া, অথবা শব্দ উহ্য থাকা ইত্যাদি।
(গ) এমন আয়াত যার ব্যাখ্যা আলেমগণ অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে জানতে পারেন। যেমন: বিজ্ঞান এবং মুয়ামালাত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/২৯) ।
উল্লেখিত তিন প্রকারের মধ্যে প্রথম প্রকারের ব্যাখ্যা কেবল আল্লাহ তায়ালা জানেন, আর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রকারের ব্যাখ্যা আলেমগণও জানেন। এ কথার স্বপক্ষে দলীল হলো:
(وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا) [سورة آل عمران: ৭].
তাফসীরকারকগণ অত্র আয়াতাংশের দুইটি অর্থ করেছেন:
(ক) অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা আলেম, তারা বলে: আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত।
(খ) অথচ আল্লাহ এবং আলেম ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত।
দুইটি অর্থকে সমন্বয় করে বলা যায় প্রথম প্রকার ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা আলেমগণও জানেন। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৫। সাত নাম্বার আয়াতের শেষাংশে এবং (৮-৯) নাম্বার আয়াতে যে সকল আলেম ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা জানেন তাদের দুইটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) তারা ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের পুরো বিষয়টা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে। কোন একটি ব্যাখ্যায় উপণিত হতে পারলে তা আল্লাহর দিকে হাওলা করে দেয়, আর কোন ব্যাখ্যায় পৌছতে না পারলে তা যথাস্থানে রেখে এর প্রতি তার ঈমানকে আরো সূদৃঢ় করে।
(খ) ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাপারে গোমরাহীতে পতিত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় পার্থনা করে এবং পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের আরো তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন:
(গ) তারা সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্ভন করে।
(ঘ) কথায় ও কাজে সত্যবাদী হয়।
(ঙ) পেট ও গোপনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে। যেমন: আবু দারদা, আবু উমামা, ওয়াথিলা ইবনু আসকা এবং আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, তারা বলেন:
سُئِلَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- مَنِ الرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ؟ قَالَ: هُوَ مَنْ بَرَّتْ يَمِينُهُ، وَصَدَقَ لِسَانُهُ، وَعَفَّ بَطْنَهُ وَفَرْجَهُ، فَذَاكَ الرَّاسِخُ (المعجم الكبير للطبراني: ৭৬৫৮).
অর্থাৎ: “রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোরআনে বর্ণিত গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেম কারা? তিনি উত্তর দিলেন: যে আলেম ন্যায়পরায়ণ, যার জিহŸা সত্যবাদী এবং যার পেট ও গোপনাঙ্গ পবিত্র সেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলিম” (আল-মুজাম আল-কাবীর লিত তাবারানী: ৭৬৫৮) ।

৬। মানুষের অন্তরের ব্যাধিসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো: ‘অন্তরের পদস্খলন’ অর্থাৎ: সময়ের পরিবর্তনের সাথে সত্য থেকে বাতিলের দিকে ঝুকে পড়া। এ ধরণের রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) আট নাম্বার আয়াত তেলওয়াতের মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। যেমন: একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يَقُولُ: “يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ، ثُمَّ قَرَأَ: ﴿رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا﴾ [آل عمران: ৮] إِلَى آخِرِ الْآيَةِ” (مسند إسحاق بن راهويه: ১৮৭৯].
অর্থাৎ: “উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা বলতেন:
“يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ”
(হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর অটল রাখুন)।
দোয়াটি পাঠ করার পর সূরা আলে-ইমরান এর নিম্নের আয়াতটি পাঠ করতেন:
(رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ).
(হে আমাদের রব! আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বলবকে বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা)” (মুসনাদে ইসহাক ইবনু রাহউইহ: ১৮৭৯) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস করা।
(খ) নিজের দল ও মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘মুহকাম’ আয়াত থাকা অবস্থায় ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দিয়ে দলীল প্রদান না করা।
(খ) কোরআনে ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’ দুই প্রকার আয়াত বিদ্যমান, এ কথা বিশ্বাস করা।
(গ) কোন মাসয়ালার হুকুম ‘মুহকাম’ আয়াতে পাওয়া গেলে, সে ব্যাপারে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের দিকে না যাওয়া।
(ঘ) হেদায়েতের উপর অটল থাকার জন্যে নিম্নের আয়াতটি সর্বদা পাঠ করা:
(رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ).

সূরা আলে-ইমরান এর (১-৬) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: আল্লাহর একাত্ববাদের প্রমাণ।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

الم (1) اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ (2) نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنْزَلَ التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ (3) مِنْ قَبْلُ هُدًى لِلنَّاسِ وَأَنْزَلَ الْفُرْقَانَ إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَاللَّهُ عَزِيزٌ ذُو انْتِقَامٍ (4) إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ (5) هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (6) [سورة آل عمران: 1-6]

আয়াতাবলীর আলোচ্য বিষয়: আল্লাহর একাত্ববাদের দলীল।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
(১) আলিফ লা-ম মী-ম।
(২) আল্লাহ, তিনি ছাড়া (সত্য) কোন ইলাহ নেই; তিনি চিরঞ্জীব, চির প্রতিষ্ঠিত ধারক।
(৩) তিনি তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যথাযথভাবে, এর পূর্বে যা এসেছে তার সত্যায়নকারী হিসেবে এবং নাযিল করেছেন তাওরাত ও ইনজীল।
(৪) ইতঃপূর্বে মানুষের জন্য হেদায়েত স্বরুপ। আর তিনি ফুরক্বান নাযিল করেছেন। নিশ্চয় যারা অস্বীকার করে আল্লাহর আয়াতসমূহ, তাদের জন্যই রয়েছে কঠিন আযাব। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধগ্রহণকারী।
(৫) নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর নিকঠ গোপন থাকে না কোন কিছু যমীনে এবং না আকাশে।
(৬) তিনি এমন সত্বা, যিনি মার্তৃগর্ভে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন যেভাবে তিনি চান, তিনি ছাড়া (সত্য) কোন ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
নাজরান থেকে একদল খ্রীষ্টান রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে ঈসা (আ.) এর জন্য উলুহিয়্যাহ সাব্যস্ত করতে চাইলে আল্লাহ তায়ালা জিবরীল (আ.) এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহকে (সা.) জানিয়ে দিলেন: আলিফ লা-ম মী-ম। আল্লাহই হলেন একমাত্র ইলাহ বা মাবূদ, তিনি ছাড়া (সত্য) কোন মাবূদ নেই। এর স্বপক্ষে দলীল হলো:
(ক) আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব এবং সৃষ্টি জগতের চির প্রতিষ্ঠিত ধারক ও ব্যাবস্থাপক হওয়ার কারণে একমাত্র তিনিই মাবূদ হওয়ার যোগ্য। ঈসা (আ.) এর মধ্যে অত্র গুণটি না থাকার কারণে সে মাবূদ হওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
(খ) তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যথাযথভাবে, যা কখনও কোন ধরণের বাতিলের ছোয়া পায়নি এবং তা মূসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ হওয়া তাওরাত ও ঈসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ হওয়া ইনজীল সহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের উপর সত্যায়নকারী। এ কোরআনই একমাত্র আল্লাহকেই সর্বদা মাবূদ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।
(গ) তিনি এমন সত্বা, যিনি মার্তৃগর্ভে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন যেভাবে তিনি চান, তিনি ছাড়া (সত্য) কোন ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর ঈসা (আ.) তার মা মারইয়ামের গর্ভে আল্লাহর ইশারায় সৃষ্টি হয়েছে। এমন গুণের মানুষ কখনও ইলাহ হতে পারে না এবং ইলাহের পুত্রও হতে পারে না।
(ঘ) নিশ্চয় আল্লাহ, আকাশ এবং যমীনের কোন কিছু তাঁর নিকট গোপন থাকে না। আর ঈসা (আ.) সব জায়গার খোজ খবর রাখতে পারতো না। সুতরাং সে ইলাহ হতে পারে না এবং ইলাহের পুত্রও হতে পারেন না।
আর আল্লাহ তায়ালা ফুরক্বান নাযিল করেছেন, যা হক্ক বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। কোরআন বলেছে: আল্লাহ হলেন প্রথম, যার পূর্বে কিছুই ছিল না, তিনিই শেষ যার পরে কিছু বাকী থাকবে না। তিনি সবাইকে রিযক দেন এবং কারো প্রতি মুখাপেখী নয়, অপরদিকে ঈসা (আ.) সহ সৃষ্টিকুলের সবকিছু তাঁর প্রতি মুখাপেখী। নিশ্চয় যারা আল্লাহর একাত্ববাদ সম্পর্কিত আয়াতাবলীকে অস্বীকার করে এবং অন্য কাউকে তাঁর সাথে ইলাহ হিসেবে শরীক করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধগ্রহণকারী। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৪, আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫০, আল-মোন্তাখাব: ৭০) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(الم) ‘আলিফ লা-ম মী-ম’, এগুলোকে ‘হুরূফ আল-মুক্বাত্তায়াত’ বলা হয়। কোরআন মাজীদের ২৯টি সূরা এ হুরূফ দিয়ে শুরু হয়েছে। প্রথম সূরা হলো ‘সূরা বাক্বারা’ এবং সর্বশেষ সূরা হলো ‘সূরা ক্বলাম’। যেহেতু এ মুকাত্তায়াত হুরূফের কোন ব্যাখ্যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.) থেকে আসেনি, সেহেতু এগুলোকে মুতাশাবিহ আয়াতের অন্তর্ভূক্ত ধরা হয়। এজন্য সকল তাফসীর গ্রন্থে মুকাত্তায়াত হরফগুলোর তাফসীর না করে ‘এ সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন’ বলা হয়েছে। তবে কোন কোন তাফসীরকারক এগুলো সূরার শুরুতে উল্লেখ করার দুইটি উপকারিতা বর্ণনা করেছেন:
(ক) যখন মুশরিকরা কোরআনের আকর্ষণের ভয়ে তা শোনা থেকে বিরত থাকতো, তখন আল্লাহ তায়ালা কোরান মাজীদের সূরাগুলোকে বিচ্ছিন্ন হরফ দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে তার ছন্দের মধ্যে নতুনত্ব আনয়নের কারণে তারা কোরআন শোনার প্রতি আগ্রহী হয়েছে। ফলে, তাদের অনেকেই কোরআন শুনে তার প্রতি ঈমান গ্রহণ করেছে।
(খ) মুশরিকরা কোরআন মাজীদকে আল্লাহর বাণী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করতো। আল্লাহ তায়ালা কোরআনের সূরাগুলো কিছু বিচ্ছিন্ন অক্ষর দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, তোমরা যে কোরআনকে অস্বীকার করছো, তা অনুরুপ অক্ষর দিয়েই গঠিত হয়েছে। কোরআনকে আল্লাহর বাণী হিসেবে মেনে নিতে তোমাদের যদি কোন আপত্তি থাকে তাহলে এ ধরণের অক্ষরসমূহ দিয়ে তোমরাও অনুরুপ একটি কোরআন অথবা এর ছোট একটি সূরার মতো একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আসো। (আইসার আল-তাফসীর: ১/১৮-১৯) ।
(الْكِتَابَ) ‘কিতাব’, সকল তাফসীরকারন একমত যে, ‘কিতাব’ দ্বারা ‘কোরআন’ কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
(الْفُرْقَانَ) ‘আল-ফুরক্বান’, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ‘ফুরক্বান’ দ্বারা ‘কোরআন’ কে বুঝানো হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৩) ।
(খ) ‘ফুরক্বান’ দ্বারা পূর্ববর্তী যুগের সকল আসমানী কিতাবকে বুঝানো হয়েছে; কারণ তিন নাম্বার আয়াতে প্রথমে ‘কিতাব’ বলে কোরআনের কথা বলে পরে ‘তাওরাত’ ও ‘ইনজীল’ কে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর চার নাম্বার আয়াতে ‘ফুরক্বান’ শব্দ দিয়ে পূর্ববর্তী যুগের সকল আসমানী কিতাবকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৪৫) ।

আয়াতাবলী অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম সুয়ূতী (র.) তার লুবাব গ্রন্থে রবী (র.) এবং মোহাম্মদ ইবনু সাহ্ল (র.) এর রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন যে, নাজরান থেকে একটি খৃষ্টান প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে তর্কে লিপ্ত হলে আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার প্রথম ৮০টি আয়াত অবতীর্ণ করে ঈসা (আ.) এর হাকীকাত এর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য বিশ্ব বাসীকে জানিয়ে দিলেন। (লুবাব আল-নুক‚ল, আল-সুয়ূতী: ৬০) ।
ইমাম ওয়াহেদী (র.) বলেছেন, তাফসীরকারকগণ বলেন: নাজরান থেকে ষাট জনের একটি খৃষ্টান প্রতিনিধি দল আছরের সালাতের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে আগমণ করলেন। তাদের সকলেই নাযরানের নের্তৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। কতিপয় সাহাবী বলছিলেন এমন প্রতিনিধিদল আর কখনও দেখিনি। তারা মাসজিদে নবভীর ভিতরে সালাত আদায়ের জন্য দাড়ালে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদেরকে বললেন: তাদেরকে সালাত আদায় করতে দাও। অতঃপর তারা পূর্ব দিকে মুখ করে সালাত আদায় করলো। সালাতের পরে তাদের মধ্য থেকে দুই জন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে কথা বলতে চাইলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তখন তাদের মধ্যে কথোপকথন হলো:
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো।
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: আমরা তোমার পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছি।
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা মিথ্যা বলেছো; কারণ তোমরা আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করছো, ক্রুসের ইবাদত করছো এবং শুকরের গোস্ত ভক্ষণ করছো, যা ইসলামের পথে বাধা।
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: ঈসা আল্লাহর পুত্র না হয়ে থাকলে তার পিতার নাম কি?
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা কি জানো না যে পুত্র সাধারণত পিতার মতো হয়?
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: হ্যা, জানি।
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা কি জানো না যে আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব, তিনি কখনও মৃতবরণ করবেন না, অথচ ঈসা (আ.) একদিন মরে যাবেন?
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: হ্যা, জানি।
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা কি জানো না যে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি জগতের চির প্রতিষ্ঠিত ধারক ও ব্যাবস্থাপক?
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: হ্যা, জানি।
রাসূলুল্লাহ (সা.): ঈসা (আ.) কি উল্লেখিত একটির ব্যাপারেও ক্ষমতা রাখেন?
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: না।
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা কি জানো না যে আল্লাহ তায়ালা আহার ও পানাহার করেন না এবং তিনি ঈসা (আ.) কে মার্তৃগর্ভে তাঁর ইচ্ছমতো আকৃতি দান করেছেন?
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: হ্যা, জানি।
রাসূলুল্লাহ (সা.): তোমরা কি জানো না যে ঈসা এর মা তাকে আরো দশ নারীর মতোই তাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, তাকে প্রসব করেছেন এবং অসহায় অবস্থায় তাকে আদরযতœ করে বড় করে তুলেছেন?
খৃষ্টান প্রতিনিধিদল: হ্যা, জানি।
রাসূলুল্লাহ (সা.): এতকিছু জানার পরেও তোমরা কিভাবে ঈসা (আ.) কে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করছো? এতে তারা সকলে চুপ হয়ে গেলো। তখন আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার প্রথম ৮০টি আয়াত অবতীর্ণ করে ঈসা (আ.) এর হাকিকত সম্পর্কে স্ববিস্তারে আলোচনা করেছেন। (আসবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১০০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। অত্র সূরার (১-৬) নাম্বার আয়াতে খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের অসারতা তুলে ধরার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের স্বপক্ষে চারটি প্রমাণ পেশ করা হয়েছে:
(ক) দুই নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা চিরঞ্জীব এবং সৃষ্টি জগতের চির প্রতিষ্ঠিত ধারক ও ব্যাবস্থাপক হওয়ার কারণে একমাত্র তিনিই মাবূদ হওয়ার যোগ্য। ঈসা (আ.) এর মধ্যে অত্র গুণটি না থাকার কারণে সে মাবূদ হওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
(খ) (৩-৪) নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যথাযথভাবে, যা কখনও কোন ধরণের বাতিলের ছোয়া পায়নি এবং তা মূসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ হওয়া তাওরাত ও ঈসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ হওয়া ইনজীল সহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের সত্যায়নকারী। এ কোরআনই তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দিয়েছে।
(গ) পাঁচ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, আকাশ এবং যমীনের কোন কিছুই আল্লাহ তায়ালার নিকট গোপন থাকে না। আর ঈসা (আ.) সব জায়গার খোজ খবর রাখতে পারতো না। সুতরাং সে ইলাহ হতে পারে না এবং ইলাহের পুত্রও হতে পারেন না।
(ঘ) ছয় নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি এমন সত্বা, যিনি মার্তৃগর্ভে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সকল প্রাণীর আকৃতি গঠন করেন, তিনি ছাড়া (সত্য) কোন ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর ঈসা (আ.) তার মা মারইয়ামের গর্ভে আল্লাহর ইশারায় সৃষ্টি হয়েছে। এমন গুণের মানুষ কখনও ইলাহ হতে পারে না এবং ইলাহের পুত্রও হতে পারে না। (তাফসীর আল-মুনীর, ওহাবা আল-জুহাইলী: ৩/১৪৮) ।
২। তিন নাম্বার আয়াতের শেষাংশে কাফির মুশরিকদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, নিশ্চয় যারা আল্লাহর একাত্ববাদ সম্পর্কিত উল্লেখিত প্রমাণসমূহকে অস্বীকার করবে এবং অন্য কাউকে তাঁর সাথে ইলাহ হিসেবে শরীক করবে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব। (তাফসীর সা’দী: ১২১) ।
৩। তিন এবং চার নাম্বার আয়াতে দেখা যায়, ‘কোরআন’ অবতীর্ণের ক্ষেত্রে ‘বাবে তাফয়ীল’ এর সীগাহ এবং তাওরাত-ইনজীল সহ পূর্ববর্তী যুগের আসমানী কিতাবের ক্ষেত্রে ‘বাবে ইফয়াল’ এর সীগাহ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, ‘কোরআন’ এর ক্ষেত্রে ‘বাবে তাফয়ীল’ এর শব্দ এবং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থের ক্ষেত্রে কেন ‘বাবে ইফয়াল’ এর শব্দ ব্যবহার করা হলো?
এর উত্তরে তাফসীরকারকগণ বলেন, ‘বাবে তাফয়ীল’ এর একটি খাসিয়াত হলো: ‘তাকসীর’ বা অধিক সংখ্যা বুঝানো এবং ‘বাবে ইফয়াল’ একটি খাসিয়াত ‘তাকলীল’ বা কম সংখ্যা বুঝানো। কোরআন মাজীদ দীর্ঘ ২৩ বছরের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই তার ক্ষেত্রে ‘বাবে তাফয়ীল’ এর সীগাহ ব্যবহার করা হয়েছে। অপরদিকে তাওরাত-ইনজীল সহ অন্যান্য আসমানী কিতাব একই সময়ে এক বারে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই তাদের ক্ষেত্রে ‘বাবে ইফয়াল’ এর সীগাহ ব্যবহার করা হয়েছে। (আল-তাহরীর ওয়া আল-তানভীর, ইবনু আশুর: ৩/১৪৮) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা।
(খ) ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস (আল্লাহ, আল্লাহর পূত্র এবং আল্লাহর স্ত্রী) থেকে নিজেকে সংরক্ষণ করা। খৃষ্টানরা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি, অনুদান, চিকিৎসা, ফ্রি বই বিতরণ ইত্যাদি সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মুসলমানদের উচিৎ ঈমান রক্ষার তাকীদে এ সুবিধাগুলোকে পরিত্যাগ করা।

সূরা আলে ইমরান এর পরিচয়:

By দৈনিক তাফসীর 2 Comments

সূরা আলে ইমরান এর পরিচয়:

সূরার নাম: বিভিন্ন তাফসীরগ্রন্থ থেকে অত্র সূরার অনেকগুলো নাম পাওয়া যায়:
(ক) আলে ইমরান (তাওকীফি নাম), সূরাটি অত্র নামেই সবার কাছে পরিচিত। এ নামটি বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ সূরায় ইমরান (আ.) এর বংশধর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তাই তার নাম আলে ইমরান রাখা হয়েছে।
(খ) জাহরা (তাওকীফি নাম) এ নামটিও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
(গ) আল-কান্জ (ইজতিহাদী নাম), আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) এ নামে নামকরণ করেছেন।
(ঘ) আল-তাইবাহ, তাওরাত গ্রন্থে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
(ঙ) সূরা আল-আমান, সূরা মু’ইনাহ, সূরা মুজাদালাহ এবং সূরা আল-ইস্তেগফার, ইমাম আবু হাইয়্যান আল-আন্দলুসী এবং ইমাম আলূসী (রহ.) তাদের তাফসীর গ্রন্থে উক্ত নামগুলো উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর মাওজূয়ী, মোস্তফা মুসলিম: ২/৪০৩-৪০৪) ।

সূরার আলোচ্য বিষয়: আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস ও তার প্রমাণ।

সূরার ফযিলত: এ সূরার অনেকগুলো ফযিলত রয়েছে, সহীহ হাদীসের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ ফযিলতগুলো হলো:
(ক) সূরা আলে ইমরান এবং সূরা বাক্বারা কিয়ামতের দিন মেঘ হয়ে পাঠককে ছায়া প্রদান করবে, আবু উমামা আল বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ، اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ، وَسُورَةَ آلِ عِمْرَانَ، فَإِنَّهُمَا تَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ، أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ، أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ، تُحَاجَّانِ عَنْ أَصْحَابِهِمَا، اقْرَءُوا سُورَةَ الْبَقَرَةِ، فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ، وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ، وَلَا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ” (صحيح مسلم: ১৯১০).
অর্থাৎ: “তোমরা কোরআন তেলাওয়াত করো, কারণ সে তার সাথীর নিকট কিয়ামতের দিন শাফায়াতকারী হিসেবে উপস্থি হবে। তোমরা সূরা বাক্বারা ও সূরা আলে ইমরান তেলাওয়াত করো, কারণ তারা কিয়ামতের দিন এমনভাবে আসবে যেন তা দুই খন্ড মেঘ, অথবা দুইটি ছায়াদানকারী, অথবা দুই ঝাঁক উড়ান্ত পাখি, যা পাঠকারীর পক্ষ হয়ে কথা বলবে। আর তোমরা সূরা বাক্বারা তেলাওয়াত করো, কারণ এ সূরাটিকে গ্রহণ করা বরকতের কাজ এবং পরিত্যাগ করা পরিতাপের কাজ। আর বাতিলের অনুসারীগণ এর বিরোধিতা করতে পারে না” (সহীহ মুসলিম: ১৯১০) ।
(খ) সূরা আলে ইমরান নিয়মিত পাঠ করলে পাঠকারীর অভাব-অনটন থাকবে না, সুনান আল-দারিমীতে একটি হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন:
“مَنْ قَرَأَ آلَ عِمْرَانَ، فَهُوَ غَنِيٌّ وَالنِّسَاءُ مُحَبِّرَةٌ” (سنن الدارمي: ৩৪৩৮).
অর্থাৎ: “যে ব্যক্তি সূরা আলে ইমরান তেলাওয়াত করে, সে ধনী; এবং সূরা নিসা সৌন্দর্যবর্ধনকারী” (সুনান আল-দারিমী: ৩৪৩৮) ।
মোহাক্কেক হাসান সুলাইম আসাদ দারানী বলেন: হাদীসের সনদ ‘জাইয়্যেদ’ বা ভালো।
(গ) অত্র সূরাটি সাবউ আল-তিওয়াল বা লম্বা সাত সূরার অন্তভ‚ক্ত, আর যে ব্যক্তি এ সাতটি সূরা শিখবে, সে আলেম। আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“مَنْ أَخَذَ السَّبْعَ الأُوَلَ مِنَ الْقُرْآنِ، فَهُوَ حَبْرٌ” (مسند أحمد: ২৪৫৭৫).
অর্থাৎ: “যে ব্যক্তি কোরআনের প্রথম সাতটি সূরা শিখবে, সে আলেম হিসেবে গণ্য হবে” (মুসনাদে আহমাদ: ২৪৫৭৫) । মোহাক্কিক শোয়াইব আরনাউত হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
উল্লেখ্য যে, কোরআনের লম্বা সাত সূরা হলো: সূরা বাক্বারা, সূরা আলে ইমরান, সূরা নিসা, সূরা মায়িদাহ, সূরা আনয়াম, সূরা আরাফ এবং সূরা তাওবাহ।
(ঘ) তাহাজ্জুদ সালাতে অত্র সূরা তেলাওয়াত করা, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাহাজ্জুদের সাত রাকায়াতে সাতটি লম্বা সূরা তেলাওয়াত করতেন। হুজাইফা (রা.) বলেন:
“قُمْتُ إِلَى جَنْبِ رَسُولِ اللهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَقَرَأَ السَّبْعَ الطِّوَلَ فِي سَبْعِ رَكَعَاتٍ” (مسند أحمد: ২৩৪১১).
অর্থাৎ: “আমি কোন এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পাশে সালাতে দারালাম, অতঃপর তিনি সাত রাকায়াতে সাতটি লম্বা সূরা তেলাওয়াত করলেন” (মুসনাদে আহমাদ: ২৩৪১১) । মোহাক্কিক শোয়াইব আরনাউত বলেন: সনদের একজন রাভী হুজাইফার চাচা, তিনি অপরিচিত হওয়ার কারণে হাদীসটি ‘হালকা যয়ীফ’ হয়েছে।

মুসহাফে সূরাটির অবস্থান: তৃতীয় সূরা।

অবতীর্ণ হওয়ার দৃষ্টিতে সূরাটির অবস্থান: ৮৭তম সূরা, সূরা বাক্বারা এর পরে এবং সূরা আনফাল এর পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে।

অবতীর্ণের স্থান: সকল মোফাসসিরের মতে, মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে, সূরা মাদানিয়্যাহ।

আয়াত সংখ্যা: ২০০টি।

অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট: অত্র সূরায় মোট একচল্লিশটি অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট রয়েছে।

সূরা আন-নাবা এর (৩৭-৪০) আয়াতের তাফসীর, আল্লাহর ক্ষমতা, কিয়ামত সংগঠিত হওয়ার নিশ্চয়তা এবং কাফিরদের প্রতি সতর্কতা।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمَنِ لَا يَمْلِكُونَ مِنْهُ خِطَابًا (37) يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا (38) ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآبًا (39) إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَالَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا (40) [سورة النبأ: 37-40]

আয়াতের আলোচ্য বিষয়:
আল্লাহর ক্ষমতা, কিয়ামত সংগঠিত হওয়ার নিশ্চয়তা এবং কাফিরদের প্রতি সতর্কতা।

আয়াতের সরল অনুবাদ:
(৩৭) যিনি আকাশসমূহ, যমীন এবং এতদোভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর রব, পরম করুনাময়। তারা তাঁর সামনে কথা বলার সামর্থ্য রাখবে না।
(৩৮) সেদিন রুহ এবং ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন সে ছাড়া অন্যরা কোন কথা বলবে না। আর সে সঠিক কথাই বলবে।
(৩৯) ঐ দিনটি সত্য। অতএব যে চায় সে তার রবের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করুক।
(৪০) নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একটি নিকটবর্তী আযাব সম্পর্কে সতর্ক করলাম। যেদিন মানুষ দেখতে পাবে, তার দুই হাত কী অগ্রে প্রেরণ করেছে এবং কাফের বলবে “হায়! আমি যদি মাটি হতাম”।

সূরা আন-নাবা এর (৩৭-৪০) আয়াতের ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা এমন যে, তিনি হলেন আকাশসমূহ, যমীন এবং এতদোভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর রব, আর দুনিয়া ও আখেরাতে পরম করুনাময়। তারা তাঁর সামনে কথা বলার সামর্থ্য রাখবে না। সেদিন জিবরীল (আ.) এবং অন্যান্য ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন সে ছাড়া অন্য কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। আর সে সঠিক কথাই বলতে পারবে, কোন ধরণের ছলছাতরীর আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পাবে না। ঐ দিনটি সত্য, যে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। অতএব যে ব্যক্তি হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা থেকে নাজাত চায় সে যেন নেকআমলের মাধ্যমে তার রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থণা করে। নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একটি নিকটবর্তী আযাব সম্পর্কে সতর্ক করলাম। যেদিন মানুষ তাদের ভালোমন্দ কৃতকর্ম -যা অগ্রে প্রেরণ করেছে- স্বচক্ষে দেখতে পাবে। পশু-পাখীর হিসাব গ্রহণ শেষে তাদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে, কাফেররা পশু-পাখীর এ দৃশ্য দেখে নিজেদের হিসাব গ্রহণের ভয়াবহতার কারণে বলতে থাকবে: “হায় আফসোস! আমরাও যদি তাদের মতো মাটি হয়ে যেতাম”। (আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০৬, আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৮৩, আল-মোন্তাখাব: ৮৮০) ।

সূরা আন-নাবা এর (৩৭-৪০) আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:

(الرُّوحُ) ‘রুহ’, শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো: ‘আত্মা’। অত্র শব্দটি কোরআন মাজীদে মোট নয় বার এসেছে, যা দ্বারা দুইটি বিষয়কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে:
(ক) মানুষের অন্তর বা আত্মা, সূরা ইসরা এর (৮৫) নাম্বার আয়াতে (২) বার এসেছে এবং দুই বারেই এর দ্বারা মানুষের ভিতরে নিহিত আত্মাকে বোঝানো হয়েছে।
(খ) জিবরীল (আ.), কোরআন মাজীদে সাত বার ‘রুহ’ শব্দটি দিয়ে জিবরীলকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যেমন: সূরা শুয়ারা এর (১৯৩) নাম্বার আয়াত, সূরা গাফির এর (১৫) নাম্বার আয়াত, সূরা আন-নাবা এর (৩৮) নাম্বার আয়াত, সূরা নাহল এর (২) নাম্বার ও (১০২) নাম্বার আয়াত, সূরা মায়রিজ এর (৪) নাম্বার আয়াত এবং সূরা ক্বাদ্র এর (৪) নাম্বার আয়াত। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
(لَا يَمْلِكُونَ) ‘তারা সক্ষম হবে না’ এবং (لَا يَتَكَلَّمُونَ) ‘তারা কথা বলতে পারবে না’ ক্রিয়া দুইটির সর্বনামদ্বয় দ্বারা ‘মানবজাতি’কে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং আয়াতের হবে: “মানবাজতি কিয়ামতের দিন আল্লাহর ভয়ে তাঁকে সম্বোধন করতে সক্ষম হবে না/ কিয়ামতের দিন মানবজাতি তাঁর অনুমতি ছাড়া কোন কথা বলতে পারবে না”। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/২৬) ।

সূরা আন-নাবা এর (৩৭-৪০) আয়াতের সাথে পূর্ববর্তী আয়াতের সম্পর্ক:

পূর্ববর্তী আয়াতাবলী তথা (৩১-৩৬) নাম্বার আয়াতে কিয়ামতের দিন মোত্তাকীদের পুরস্কারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আর অত্র আয়াতাবলী তথা (৩৭-৪০) নাম্বার আয়াতে কিয়ামতের দিনের আল্লাহর ক্ষমতা, কিয়ামত সংগঠিত হওয়ার নিশ্চয়তা এবং কাফিরদের প্রতি সতর্কতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতের সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক সুস্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/২৬) ।

সূরা আন-নাবা এর (৩৭-৪০) আয়াতের শিক্ষা:
১। অত্র সূরার (৩৭-৩৮) নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় কিয়ামতের দ্বিন আল্লাহ তায়ালার সামনে তার ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস করবে না। তবে দুইটি শর্তে মানুষ আল্লাহর সামনে কথা বলতে পারবে:
(ক) আল্লাহ কথা বলার অনুমতি প্রদান করলে।
(খ) অনুমতি পাওয়ার পর কেবল সত্য কথা বলতে পারবে। এ সম্পর্কে কোরআন মাজীদের সূরা হুদ এবং সূরা ত্বহা এ দুইটি আয়াত পাওয়া যায়। সূরা হুদ এ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(يَوْمَ يَأْتِ لا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ) [سورة هود: ১০৫].
অর্থাৎ: “এমন একটি দিন আসছে, যে দিন তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কোন কথা বলতে পারবে না” (সূরা হুদ: ১০৫) । অনুরুপভাবে সূরা ত্বহা এ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(يَوْمَئِذٍ لا تَنْفَعُ الشَّفاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا) [سورة طه: ১০৯].
অর্থাৎ: “সেদিন কারো কোন সুপারিশই কাজে আসবে না, অবশ্য যাকে করুণাময় আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিবেন এবংযার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, তার ব্যাপার আলাদা” (সূরা ত্বহা: ১০৯) । (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/২৭) ।
২। উনচল্লিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, কিয়ামত সত্য, তা অবশ্যই সংগঠিত হবে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং যারা সেদিন নাজাত পেতে চায়, তারা যেন ঈমান গ্রহণ পূর্বক সৎআমল করে।
৩। চল্লিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তিনটি পন্থা অবলম্ভন করে কাফির-মুশরিকদেরকে কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন যে:
(ক) কিয়ামতের আযাব খুবই কাছে, আমি তোমাদেরকে নিকটবর্তী আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেছি। এছাড়াও কোরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে কিয়ামতকে নিকটবর্তী বলা হয়েছে। যেমন: সূরা নাযিয়াত এর (৪৬) নাম্বার আয়াত, সূরা হাশর এর (১৮) নাম্বার আয়াতে কিয়ামতের দিনকে আগামী কাল বলা হয়েছে।
(খ) কিয়ামতের দিন সকলে নিজের ভালোমন্দ কৃতকর্ম স্বচক্ষে দেখতে পাবে, যেদিন মানুষ নিজের পূর্ব প্রেরিত আমলের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এছাড়াও সূরা আলে ইরমান এর (৩০) নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: প্রত্যেকে সেদিন নিজের ভালোকর্ম কাছে উপস্থিত পাবে, আর যারা খারাপ কাজ করেছে, তারা তাদের আমল থেকে দুরে সরে যেতে চাইবে।
(গ) কাফিররা সেদিন নিজেদের ভয়াবহ পরিণতি দেখে মাটি হওয়ার বাসনা পেশ করবে, এছাড়াও কোরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে সেদিন কাফিররা দুনিয়ায় পুণরায় ফিরে আসতে চাইবে, কেউ কেউ নিজেদের উপর অভিশাপ দিবে, আবার কেউ কেউ নিজের নেতৃবৃন্দের প্রতি অভিশাপ দিবে। কিন্তু কোন কিছুতেই তারা আর রক্ষা পাবে না।
৪। অত্র সূরার শেষের দুই আয়াত তথা (৩৯-৪০) নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় কিয়ামতের দিন মানবজাতি দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে: (ক) একদল মুমিন, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ধন্য হবে, (খ) আরেক দল কাফের, তারা আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়ে ধ্বংস হবে। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান এনে আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করা।
(খ) আল্লাহ তায়ালার মহা পুরস্কারের আশায় বেশী বেশী নেকআমল করা।

সূরা আন-নাবা এর (৩১-৩৬) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: কিয়মতের দিন সৌভাগ্যবান মুমিনদের প্রতিদান।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا (31) حَدَائِقَ وَأَعْنَابًا (32) وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا (33) وَكَأْسًا دِهَاقًا (34) لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا كِذَّابًا (35) جَزَاءً مِنْ رَبِّكَ عَطَاءً حِسَابًا (36) [سورة النبأ: 31-36]

আয়াতের আলোচ্য বিষয়: কিয়মতের দিন সৌভাগ্যবান মুমিনদের প্রতিদান।

আয়াতের সরল অনুবাদ:

(৩১) নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা।
(৩২) উদ্যানসমূহ এবং আঙ্গুরসমূহ।
(৩৩) এবং সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী।
(৩৪) আর পরিপূর্ণ পানপাত্র।
(৩৫) সেখানে তারা কোন অসার ও মিথ্যা কথা শুনবে না।
(৩৬) তোমার রবের পক্ষ থেকে প্রতিফল, যথোচিত দানস্বরুপ।

আয়াতের ভাবার্থ:

নিশ্চয় যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করে তারা জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে স্থায়ী জান্নাত লাভের মাধ্যমে মহাসফলতা লাভ করবেন। সেখানে তাদের আরাম-আয়েসের জন্য ফুলে-ফলে সুশোভিত উদ্যানসমূহ রয়েছে এবং খাবার হিসেবে রয়েছে সুঘ্রানযুক্ত আঙ্গুরসমূহ। এবং উপভোগের জন্য রয়েছে সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী। এছাড়াও পানীয় হিসেবে রয়েছে পরিপূর্ণ স্বচ্ছ পানপাত্র, যা অনবরত থাকবে। সেখানে তারা কোন অসার ও মিথ্যা কথা শুনবে না। উল্লেখিত পুরস্কারগুলো তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রতিফল এবং যথোচিত দানস্বরুপ। (আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০৫-৫০৬, আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৮৩, আল-মোন্তাখাব: ৮৭৯) ।

সূরা আন-নাবা এর (৩১-৩৬) আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:

(مَفَازًا) ‘সফলতা’, শব্দটি ‘ক্রিয়ামূল’ অথবা ‘স্থান বাচক শব্দ’ হতে পারে। অত্র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র.) কয়েকটি মত বর্ণনা করেছেন:
(ক) এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি বা জান্নাত লাভকে বুঝানো হয়েছে।
(খ) আরেকদল তাফসীরকারক বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া। ইমাম রাযী (র.) প্রথম মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৩১/২১) । তবে এখানে দুইটি মতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। এ ধরণের মতবিরোধকে ‘ইখতেলাফ তানাওয়ী’ বলে।

(دِهَاقًا) ‘পরিপূর্ণ’, তাফসীরকারকগণ শব্দটির কয়েকটি অর্থ করেছেন:
(ক) ইবনু আব্বাস (রা.) শব্দটিকে বিভিন্ন সময়ে ‘পরিপূর্ণ’ অর্থে ব্যবহার করেছেন।
(খ) আবু হুরায়রা (রা.) বলেন: শব্দটির অর্থ হলো ‘অনবরত’ বা ‘বিরামহীন’।
(গ) দাহ্হাক (র.) বলেন: এর অর্থ হলো: ‘স্বচ্ছ’। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৩১/২২) । তবে এখানে তিনটি মতকেই একই সাথে উদ্দেশ্য করা যায়, কারণ কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে বুঝা যায়, জান্নাতের পানীয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে: তা অধিক স্বচ্ছ, পানপাত্র ভর্তি থাকবে এবং অনবরত চলবে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

সূরা আন-নাবা এর (৩১-৩৬) আয়াতের সাথে পূর্ববর্তী আয়াতের সম্পর্ক:

পূর্ববর্তী আয়াতাবলী তথা (১৭-৩০) নাম্বার আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে যে, কিয়ামত কখন সংগঠিত হবে তা পূর্ব নির্ধারিত, যা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। অনুরুপভাবে কিয়ামতের অবস্থা এবং জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আর অত্র আয়াতসমূহ তথা (৩১-৩৬) নাম্বার আয়াতে কিয়ামতের দিন মোত্তাকীদের পুরস্কারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতের সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক সুস্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/২২) ।

সূরা আন-নাবা এর (৩১-৩৬) আয়াতের শিক্ষা:

১। অত্র সূরার (৩১-৩৫) নাম্বার আয়াতে যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করে তাদের জন্য পাঁচটি পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে:
(ক) তারা জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে স্থায়ী জান্নাত লাভের মাধ্যমে মহাসফলতা লাভ করবেন।
(খ) সেখানে তাদের আরামআয়েসের জন্য ফুলে-ফলে সুশোভিত উদ্যানসমূহ রয়েছে এবং খাবার হিসেবে রয়েছে সুঘ্রানযুক্ত আঙ্গুরসমূহ।
(গ) উপভোগের জন্য রয়েছে সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী।
(ঘ) পানীয় হিসেবে রয়েছে পরিপূর্ণ স্বচ্ছ পানপাত্র, যা অনবরত থাকবে।
(ঙ) সেখানে তারা কোন অসার ও মিথ্যা কথা শুনবে না। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/২৪) ।
২। ছত্রিশ নাম্বার আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, কারো পক্ষে শুধু তার নেকআমলের বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়, বরং জান্নাতে প্রবেশ করতে হলে নেকআমলের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত প্রত্যাশী হতে হবে। এক কথায় বলা যায় জান্নাতে প্রবেশের জন্য দুইটি জিনিস প্রয়োজন হবে: (ক) নেকআমল এবং (খ) আল্লাহর দয়া। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

আয়াতাবলীর আমল:

(ক) পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান এনে আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করা।
(খ) আল্লাহ তায়ালার মহা পুরস্কারের আশায় বেশী বেশী নেকআমল করা এবং তাঁর রহমত পাওয়ার জন্য দোয়া করা।

সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: কিয়ামতের অবস্থা এবং সেখানকার শাস্তির ধরণ।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا (17) يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا (18) وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا (19) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (20) إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21) لِلطَّاغِينَ مَآبًا (22) لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا (23) لَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا (24) إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا (25) جَزَاءً وِفَاقًا (26) إِنَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا (27) وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا كِذَّابًا (28) وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا (29) فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا (30) [سورة النبأ: 17-30]

আয়াতের আলোচ্য বিষয়: কিয়ামতের অবস্থা এবং সেখানকার শাস্তির ধরণ।

আয়াতের সরল অনুবাদ:

(১৭) নিশ্চয় ফয়সালার দিন নির্ধারিত আছে।

(১৮) সেদিন সিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন তোমরা দলে দলে আসবে।

(১৯) আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে, ফলে তা বহু দ্বারবিশিষ্ট হবে।

(২০) আর পাহাড়সমূহকে চলমান করা হবে, ফলে সেগুলো মরীচিকা হয়ে যাবে।

(২১) নিশ্চয় জাহান্নাম গোপন ফাঁদ।

(২২) সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন স্থল।

(২৩) সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।

(২৪) সেখানে তারা কোন শীতলতা আস্বাদন করবে না এবং না কোন পানীয়।

(২৫) ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া।

(২৬) উপযুক্ত প্রতিফল স্বরুপ।

(২৭) নিশ্চয় তারা হিসেবের আশা করতো না।

(২৮) আর তারা আমার আয়াতসমূহকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছিল।

(২৯) আর সবকিছুই আমি লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছি।

(৩০) সুতরাং তোমরা স্বাদ গ্রহণ করো, আমি তো কেবল তোমাদের আযাবই বৃদ্ধি করবো।

আয়াতের ভাবার্থ:

নিশ্চয় পূর্বে যারা এসেছিলো এবং পরে যারা আসবে সকলের জন্য কিয়ামতের দিন নির্ধারিত রয়েছে, যেদিন সকল প্রাণীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। সেদিন সিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন মানুষ তাদের দলনেতার সাথে দলে দলে হাশরের ময়দানে জড়ো হবে। আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে, ফলে তা বহু দ্বারবিশিষ্ট হবে এবং সেখান থেকে ফেরেশতারা হাশরের ময়দানে অবতরণ করবে। আর পাহাড়সমূহকে চলমান করা হবে, ফলে সেগুলো মরীচিকার রুপ ধারণ করে নিশ্চিন্থ হয়ে যাবে। নিশ্চয় জাহান্নাম পাপীদের জন্য গোপন ফাঁদ এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন স্থল। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। উপযুক্ত প্রতিফল স্বরুপ সেখানে তারা ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া কোন শীতলতা এবং কোন পানীয় আস্বাদন করবে না। নিশ্চয় তারা দুনিয়ায় হিসাবের আশা করতো না। আর তারা আমার আয়াতসমূহকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করতো। আর আমি তাদের সকল অপকর্মকে লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছি। সুতরাং তারা এ আযাবের স্বাদ গ্রহণ করবে, আমি তো কেবল তাদের আযাবই বৃদ্ধি করবো। (আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০৩-৫০৪, আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৮২, আল-মোন্তাখাব: ৮৭৯) ।

সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:

(بَرْدًا) ‘ঠান্ডা’, অধিকাংশ তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অত্র আয়াতাংশ দ্বারা দুইটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে:
(ক) জাহান্নামের আযাব শিথিল করা, সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: “তাদের জন্য সেখানে জাহান্নামের আযাব শিথিল করা হবে না”।
(খ) তন্দ্রা বা ঘুম, সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: “তারা সেখানে ঘুমানোর সুযোগ পাবে না”। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১৯, আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০৩) ।

সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের সাথে পূর্ববর্তী আয়াতের সম্পর্ক:

পূর্ববর্তী আয়াত তথা (১-১৬) নাম্বার আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এ ইউনিভার্সকে পুরোপুরি ধ্বংস করে নুতন এক জগৎ সৃষ্টি করে সেখানে সকল প্রাণীকে জড়ো করে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে সক্ষম। আর অত্র আয়াতাবলী তথা (১৭-৩০) নাম্বার আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে যে, কিয়ামত কখন সংগঠিত হবে তা পূর্ব নির্ধারিত, যা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। অনুরুপভাবে কিয়ামতের অবস্থা ও জাহান্নামের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতের সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক সুস্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১৬) ।

সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের শিক্ষা:

১। অত্র সূরার সতের নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য নির্ধারিত, যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে রয়েছে। অতঃপর (১৮-২০) নাম্বার আয়াতে কিয়ামতের তিনটি ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
(ক) ইসরাফীল (আ.) এর সিঙ্গায় দ্বিতীয় ফ‚ঁকের পরে সকল প্রাণী কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে জড়ো হবে। আর মানুষ তাদের নেতার সাথে দলে দলে ময়দানে মাহশারে একত্র হবে। এ সম্পর্কে কোরআন মাজীদের সূরা ইসরা এর একাত্তর নাম্বার আয়াতে এসেছে:
(يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ فَمَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَأُولَئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَابَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا) [الإسراء: ৭১] .
অর্থাৎ: “যেদিন আমি প্রত্যেক জাতিকে তাদের নেতাদের সাথে ডাকবো, সেদিন যাদের আমলনামা ডানহাতে দেওয়া হবে, তারা পড়া শুরু করবে, তাদের উপর সেদিন বিন্দুমাত্র যুলম করা হবে না” (সূরা ইসরা: ৭১) ।
(খ) সেদিন আকাশ ফেটে বহু দরজা বিশিষ্ট হবে এবং ফেরেশতাগণ আকাশ থেকে অবতরণ করবে। এর মাধ্যমে বিশ্ব রুপরেখা এবং রীতিনীতি সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর আল্লাহ তায়ালা অস্থায়ী রাজাবাদশাহদের কাছ থেকে সকল ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি একক ক্ষমতার অধিকারী হবেন। এ সম্পর্কে সূরা ইনফিতার এবং সূরা ইনশিক্বাক এর প্রথম আয়াতাবলীতে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও সূরা ফুরকান এর পচিশ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
(وَيَوْمَ تَشَقَّقُ السَّمَاءُ بِالْغَمَامِ وَنُزِّلَ الْمَلَائِكَةُ تَنْزِيلًا (২৫) الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمَنِ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا (২৬)) [سورة الفرقان: ২৫-২৬].
অর্থাৎ: “এবং যেদিন আকাশ তার মেঘমালা নিয়ে ফেটে পড়বে, আর দলে দলে ফেরেশতারা যমীনে নেমে আসবে। সেদিন চুড়ান্ত বাদশাহী হবে একমাত্র দয়াময় আল্লাহ তায়ালার জন্যে, যারা তাকে অস্বীকার করেছে তাদের উপর সেদিনটি হবে খুবই কঠিন” (সূরা ফুরকান: ২৫) ।
(গ) পাহাড়গুলোকে তাদের জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলে সমতল করা হবে, ফলে তা মরীচিকার মতো হয়ে যাবে (আন-নাবা: ২০), তা সম্পূর্ণরূপে চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে ধুলাবালিতে রুপান্তরিত হবে (ওয়াক্বিয়া: ৫-৬) এবং তা এক পর্যায়ে বাতাশে ধুনা তুলার মতো উড়তে থাকবে (আল-ক্বারিয়াহ: ৫/ ত্বহা: ১০৫/ আন-নমল: ৮৮) ।
২। অত্র সূরার (২১-২৬) আয়াতে কিয়ামতের দিন হতভাগা কাফের-মোশরেকদের ও সীমালঙ্ঘনকারীদের পাঁচটি ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে:
(ক) জাহান্নাম তাদের জন্য গোপন ফাঁদ হবে।
(খ) জাহান্নাম হবে তাদের একমাত্র আবাসস্থল।
(গ) তারা সেখানে যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।
(ঘ) তাদের জন্য সেখানে ঘুমানোর কোন সুযোগ থাকবে না, অথবা তাদের জন্য শাস্তিকে বিন্দুমাত্র শিথিল করা হবে না।
(ঙ) জাহান্নামে তাদের পানীয় হবে ফুটন্ত পানি ও পুজ।
৩। অত্র সূরার (২৭-২৮) নাম্বার আয়াতে কাফিররা উল্লেখিত শাস্তির উপযোগী হওয়ার দুইটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) দুনিয়ায় থাকা কালে তারা মনে করতো কিয়ামতের দিন কোন হিসাবনিকাশ হবে না।
(খ) তারা আল্লাহর আয়াতবলীকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করতো।
৪। উনত্রিশ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা সকলের কৃতকর্ম কিতাবে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন, যার আলোকে কিয়ামতের দিন বিচার হবে।
৫। ত্রিশ নাম্বার আয়াতে কাফিররা জাহান্নামে প্রবেশের পর তাদেরকে লাঞ্চিত করার জন্য একটি ঘোষণা দেওয়া হবে: তোমরা দুনিয়াতে আল্লাহর অবাধ্য ছিলে, এখন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করো, আজ তোমাদের জন্য শাস্তি কেবল বাড়ানো হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন: জাহান্নামীদের জন্য অত্র আয়াতের চেয়ে অধিক কষ্টের আয়াত আর দ্বিতীয়টি নেই। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১৯) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:

(ক) পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান এনে আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করা।
(খ) আল্লাহর আয়াতাবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।

সূরা আন-নাবা এর (১-১৬) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: পুনরুত্থান দিবস এবং তা সংগঠিত হওয়ার প্রমাণ।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ (1) عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ (2) الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ (3) كَلَّا سَيَعْلَمُونَ (4) ثُمَّ كَلَّا سَيَعْلَمُونَ (5) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا (6) وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا (7) وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا (8) وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا (9) وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (10) وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا (11) وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا (12) وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا (13) وَأَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا (14) لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا (15) وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا (16) [سورة النبأ: 1-16]

 

আয়াতের আলোচ্য বিষয়: পুনরুত্থান দিবস এবং তা সংগঠিত হওয়ার প্রমাণ।

আয়াতের সরল অনুবাদ:
(১) কোন বিষয় সম্পর্কে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করছে?
(২,৩) মহাসংবাদটি সম্পর্কে, যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে।
(৪) কখনও নয়, তারা অচিরেই জানতে পারবে।
(৫) আবারও বলি, কখনও নয়, তারা অচিরেই জানতে পারবে।
(৬,৭) আমি কি যমীনকে শয্যা এবং পর্বতসমূহকে পেরেক বানাইনি?
(৮) আর আমি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।
(৯) আর আমি তোমাদের নিদ্রাকে বিশ্রাম বানিয়েছি।
(১০) আর রাত্রকে বানিয়েছি আবরণ।
(১১) আর দিনকে বানিয়েছি জীবিকার্জনের সময়।
(১২) আর আমি তোমাদের উপর বানিয়েছি সাতটি সুদৃঢ় আকাশ।
(১৩) আর আমি সৃষ্টি করেছি উজ্জ্বল একটি প্রদীপ।
(১৪,১৫) আর আমি মেঘমালা থেকে প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি, যাতে আমি তা দিয়ে শস্য ও উদ্ভিদ উৎপাদন করতে পারি।
(১৬) আরো উৎপন্ন করতে পারি ঘন উদ্যানসমূহ।
(আল-কোরআনুল কারীম সরল অনুবাদ: ১২২৬-১২২৭, আহাসানুল বায়ান: ১০৫০-১০৫১, কোরআন মাজীদ সহজ-সরল অনুবাদ: ৯৬৫-৯৬৬) ।

আয়াতের ভাবার্থ:
কোন বিষয় সম্পর্কে কোরাইশ গোত্রের কাফের-মোশরেকরা পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? অবশ্যই তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নিয়ে আসা কোরআনকে সম্পর্কে মতভেদ করছে, কারণ এ কোরআন পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন: এ ধরণের মতভেদ করা কখনও ঠিক নয়, তারা অচিরেই পুনরুত্থান দিবসকে স্বচক্ষে দেখতে পাবে। আল্লাহ তায়ালা আবারও তাকীদ দিয়ে বলেছেন, এ ধরণের আচরণ কখনও ঠিক নয়, তারা অচিরেই এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে জানতে পারবে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরাত বর্ণনার মাধ্যমে পুনরুত্থান দিবস সংগঠিত হওয়ার যৌক্তিক দলীল পেশ পূর্বক বলেন: তোমরা কি দেখছোনা আমি যমীনকে সমতল আকারে তৈরি করে তোমাদের জন্য শয্যা হিসেবে নির্ধারণ করেছি এবং পর্বতসমূহকে যমীনের সাথে পেরেক মেরে দিয়েছি যাতে তা স্থির থাকে। আর আমি প্রজননের জন্য তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। আর আমি নিদ্রাকে তোমাদের জন্য বিশ্রাম বানিয়েছি। আর রাত্রকে বানিয়েছি আবরণ, যাতে আরামে বিশ্রাম নিতে পারো। আর দিনকে বানিয়েছি জীবিকার্জনের সময়, যাতে তোমরা জীবিকার্জন করে আরাম আয়েশে জীবনযাপন করতে পারো। এছাড়াও আমি তোমাদের উপর সাতটি সুদৃঢ় আকাশকে যমীনের জন্য ছাদ করেছি, যা তারকারাশি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। তোমাদেরকে বাচিয়ে রাখার জন্য সূর্য নামক একটি উজ্জ্বল প্রদীপ সৃষ্টি করেছি। অনুরুপভাবে আমি মেঘমালা থেকে প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি, যাতে আমি তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য শস্য, উদ্ভিদ এবং ঘন উদ্যানসমূহ উৎপাদন করতে পারি। উল্লেখিত ক্ষমতা দেখেও তোমরা বিশ্বাস করছো না যে, যিনি এত কিছু করতে পেরেছেন, তিনি অবশ্যই পুনরুত্থান দিবসে মানবজাতিকে পুনর্জীবিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে পারবেন। (আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০১-৫০২, আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৮২, আল-মোন্তাখাব: ৮৭৭-৮৭৮) ।

আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(النَّبَإِ الْعَظِيمِ) ‘মহাসংবাদ’, অত্র আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি মত পাওয়া যায়: (ক) আল-কোরআন আল-কারীম এবং (খ) কিয়ামতের দিন। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৪৩৪) ।
তবে ইমাম ইবনু কাছীর (র.) দ্বিতীয় মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কারণ তৃতীয় নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করে। (তাফসীর ইবনু কাছীর: ৮/৩০২) ।
(سِرَاجًا وَهَّاجًا) ‘একটি উজ্জ্বল প্রদীপ’, অত্র আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সূর্য। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৪৩৪) ।
(سَبْعًا) ‘সাতটি’, অত্র আয়াতাংশে সাত সংখ্যা দ্বারা সাত আকাশকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১১) ।

অত্র সূরার সাথে পূর্ববর্তী সূরার সম্পর্ক:
পূর্ববর্তী সূরা তথা সূরা মুরসালাত এ পুনরুত্থান দিবস সংগঠিত করা আল্লাহ তায়ালার জন্য খুবই সহজ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর অত্র সূরা তথা সূরা আন-নাবা তেও একই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। (তাফসীর মাওজূয়ী, মোস্তফা মুসলিম: ১০/৩) ।

সূরা আন-নাবা এর (১-২) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইবনু জারীর আততবারী (র.) হাসান (র.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রিসালাতের দায়িত্ব নিয়ে প্রেরিত হলে মক্কার কাফের-মোশরেকরা নিজেদের মধ্যে কানাকানি শুরু করে দেয়। তখন আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার প্রথম দুইটি আয়াত অবতীর্ণ করেন। (লুবাব আল-নুক‚ল, সুয়ূতী: ৩৫১) ।

সূরা আন-নাবা এর (১-১৬) আয়াতের শিক্ষা:
১। অত্র সূরার (১-৩) নাম্বার আয়াতে কোরআন এবং পুনরুত্থান দিবসকে মহান বিষয় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অনুরুপভাবে পুনরুত্থান দিবস সংগঠিত হবে মর্মে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
২। অত্র সূরার (৪-৫) আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা কোরআন ও পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করে, তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) যে বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন তার সত্যতা অচিরেই জানতে পারবে।
৩। অত্র সূরার (৬-১৬) নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নয়টি বিষয়ে তাঁর অপরিসীম ক্ষমতা বর্ণনার মাধ্যমে পুনরুত্থান দিবস সংগঠিত করতে তিনি যে সক্ষম তার স্বপক্ষে যৌক্তিক দলীল পেশ করেছেন:
(ক) যমীনকে সমতল আকারে বিছানা স্বরুপ তৈরি করা।
(খ) পর্বতসমূহকে যমীনের সাথে পেরেক মেরে পৃথিবীকে স্থির রাখা।
(গ) প্রজননের জন্য মানবজাতিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা।
(ঘ) নিদ্রাকে প্রাণীকুলের জন্য বিশ্রাম হিসেবে নির্ধারণ করা।
(ঙ) বিশ্রামকে আরামদায়ক বনানোর জন্য রাত্রকে আবরণ বানানো।
(চ) দিনকে জীবিকার্জনের সময় হিসেবে নির্ধারণ করা।
(ছ) সাতটি সুদৃঢ় আকাশকে যমীনের জন্য ছাদ বানিয়ে তা তারকারাশি দিয়ে সজ্জিত করা।
(জ) সৃষ্টিকুলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সূর্য নামক একটি উজ্জ্বল প্রদীপ সৃষ্টি করা।
(ঝ) সৃষ্টিকুলের জীবিকার জন্য শস্য, উদ্ভিদ এবং ঘন উদ্যানসমূহ উৎপাদন করার লক্ষ্যে মেঘমালা থেকে পরিমিত পানি বর্ষণ করা।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
(ক) তাহাজ্জুদ সালাতে সূরা আন-নাবা তেলাওয়াত করা।
(খ) পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান এনে আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করা।
(গ) কোন বিষয়ে নিজেদের ভিতর অতি কানাকানি না করে বিশেষজ্ঞদের স্মরনাপন্ন হওয়া।

error: Content is protected !!