Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের (৭৫-৭৭) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আমানত ফেরত প্রদান ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার গুরুত্ব এবং এ বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানের চরিত্র।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَمِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِقِنْطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لَا يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلَّا مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَائِمًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (75) بَلَى مَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ وَاتَّقَى فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ (76) إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (77)﴾ [سورة آل عمران: 75-77]

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:
আমানত ফেরত প্রদান ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার গুরুত্ব এবং এ বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানের চরিত্র।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭৫। আর ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে কিছু লোক আছে, যাদের কাছে যদি অঢেল সম্পদ আমানত রাখো, তবুও সে তা তোমার নিকট আদায় করে দিবে; তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যাদের কাছে যদি আমানত রাখো একটি দীনার, তবে তার পিছনে লেগে না থাকলে সে তা তোমাকে আদায় করবে না; এটি এ কারণে যে, তারা বলে থাকে: আমাদের উপর উম্মীদের ব্যাপারে কোন পাপ নেই; আর তারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে, অথচ তারা জানে।
৭৬। হ্যাঁ, যে তার প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ মোত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন ।
৭৭। নিশ্চয় যারা আল্লাহর অঙ্গীকার এবং তাদের শপথের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য ক্রয় করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আর আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের একটি দল এতই আমানতদার যে, তাদের কাছে কেউ যদি অঢেল সম্পত্তিও আমানত রাখে, তাহলে তারা তা মালিকের কাছে অনায়াসে ফেরত প্রদান করে। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনু সালামের কাছে কোরাইশ বংশের এক ব্যক্তি এক হাজার দুই শত আওকিয়া আমানত রাখলে তিনি তা যথসময়ে ফেরত দিয়েছিলেন। অপরদিকে তাদের মধ্যে আরেকটি দল রয়েছে যাদের কাছে কেউ সামান্য সম্পদ আমানত রাখলেও তারা তা মালিকের কাছে ফেরত দিতে গড়িমসি করে থাকে। এ আমানত ফেরত পাওয়ার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে বাধ্য করা না হলে তারা তা ফেরত না দিয়ে বলে থাকে: মুশরিকদের সম্পদ ফেরত দেওয়া জরুরী না, তাওরাত গ্রন্থে তা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। যেমন: কা’ব বিন আশরাফের কাছে কোরাইশ বংশের এক ব্যক্তি একটি মাত্র দীনার আমানত রাখলে সে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ খেয়ানতী মনোভাবের জবাবে বলেন: তাদের জন্য কারো আমানতের খেয়ানত করাকে হালাল করা হয়নি, বরং তারা জেনে বুঝে মিথ্যাচার করছে। বরং তাওরাতের বিধান হলো: যে কেউ তাদের কাছে কোন কিছু আমানত রাখলে তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া তাদের প্রতি ওয়াজিব। যারা এ বিধান মেনে চলবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভালোবাসবেন।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা যারা তাঁর সাথে গৃহীত অঙ্গীকারের ভঙ্গকারী এবং আমানতের খেয়ানতকারীর জন্য পাঁচটি শাস্তি বর্ণনা করেছেন:
(ক) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ থাকবে না।
(খ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না।
(গ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না।
(ঘ) আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিচ্ছন্ন করবেন না।
(ঙ) তাদের জন্য আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩৪-৩৩৫, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬৬-২৬৮, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭-৯৮) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿بِقِنْطَارٍ﴾ “অঢেল সম্পদ”, ‘ক্বিনতার’ শব্দটি আরবী, যা অনেক পরিমাণ বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। (তাফসীর সা’দী: ১/১৩৫) ।
﴿بِدِينَارٍ﴾ “সামান্য সম্পদ”, ‘দীনার’ শব্দটি দ্বারা ক্ষুদ্রাংশের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
﴿الْأُمِّيِّينَ﴾ “নিরক্ষর”, এখানে আয়াতাংশ দ্বারা আরব অথবা কোরাইশদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
﴿سَبِيلٌ﴾ “পথ”, তবে এখানে আয়াতাংশ দ্বারা ‘গুনাহ’ কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।

(৭৭) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র.) বর্ণনা করেছেন যে, আশয়াচ (রা.) বলেন: আমার এবং এক ইহুদী ব্যক্তির যৌথ এক টুকরা ভ‚মি ছিল। আমি আমার অংশ চাইলে সে তা দিতে অস্বীকার করে। অতঃপর আমি বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে পেশ করলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি ভ‚মির মালিক হওয়ার স্বপক্ষে কোন দলীল আছে? আমি উত্তরে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার কাছে কোন প্রমাণপত্র নেই। তখন তিনি ইহুদী ব্যক্তিকে যমীনের মালিক হওয়া মর্মে শপথ করতে বললেন। তখন আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা.), তা হলে তো সে মিথ্যা শপথ করে ভ‚মির মালিক হয়ে যাবে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে ইহুদী ব্যক্তিকে সতর্ক করে দিলেন যে, কোন অবস্থাতেই মিথ্যা শপথ করা যাবে না।
ইমাম বুখারী (র.) বর্ণনা করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আবি আওফা (রা.) বলেন: এক ইহুদী বিক্রেতা মুসলমান ক্রেতাদেরকে ধোকা দেওয়ার জন্য পণ্যের গুণাগুণ অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করতো। আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে তাকে সতর্ক করে দিলেন।
ইবনু হাযার আসকালানী (র.) বলেন: উল্লেখিত দুই হাদীসের মধ্যে কোন অসামঞ্জস্যতা নেই, বরং এখানে আয়াতটি অবতীর্ণের দুইটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম তবারী (র.) ইকরামাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আয়াতটি হুয়াই ইবনু আখতাব, কা’ব বিন আশরাফ এবং অন্যান্য ইহুদী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা তাওরাতের বিধানকে গোপন রেখে মনগড়া বানানো বিধানকে সাধারণ মানুষের কাছে উল্লেখ করে আল্লাহর শপথ করে বলতো এ বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। (লুবাব আন-নুকুল, সুয়ূতী: ৬৫) ।

পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে আক্বীদা সম্পৃক্ত বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানদের নিজেদের অবস্থান এবং মুমিনদেরকে ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতে মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। (আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পঁচাত্তর নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে আমানতদার এবং খেয়ানতকারী, দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। তবে এরা কারা? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে তিনটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা আমানতদার এবং যারা ইহুদী ধর্মে রয়ে গেছে, তারা খেয়ানতকারী।
(খ) খৃষ্টানরা আমানতদার এবং ইহুদীরা খেয়ানতকারী।
(খ) আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম আমানতদার এবং ফিনহাস ইবনু আজুরা খেয়ানতকারী। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, আল-রাযী: ৮/২৬২) ।
২। পচাত্তর নাম্বার আয়াতের তাফসীরে ইমাম তবারী (র.) বলেন: ইহুদী-খৃষ্টানদের কাছে আমানত রাখা হলে তারা স্বাভাবিক ভাবে তা ফেরত দিতো, কিন্তু আমনতকারী যদি ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যেত, তাহলে তার কাছে আমনত ফেরত দিতে অস্বীকার করে বলতো: তাদের আমানত ফেরত না দিলে গুনাহ হবে না। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৫২৩)।
৩। (৭৬-৭৭) নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা আল্লাহ তায়ালার সাথে প্রদত্ত ওয়াদা পূর্ণ করবে অর্থাৎ: আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধকে মান্য করবে ও রাসূলুল্লাহকে (সা.) রাসূল হিসেবে মেনে নিবে এবং মানুষের সাথে কৃত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করবে তাদের পুরস্কার হলো: আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা। অপরদিকে যারা অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করবে, তাদের জন্য পাঁচটি শাস্তি রয়েছে:
(ক) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই।
(খ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না।
(গ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না।
(ঘ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পবিত্র করবেন না।
(ঙ) তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানদের সবাইকে এক ওজনে পরিমাপ না করা।
(খ) আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য করা।
(গ) মানুষের সাথে প্রদত্ত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৭২-৭৪) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: আহলে কিতাব কর্তৃক দ্বীনকে নিয়ে তামাশা ও আল্লাহর জবাব।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آمِنُوا بِالَّذِي أُنْزِلَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ وَاكْفُرُوا آخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ (72) وَلَا تُؤْمِنُوا إِلَّا لِمَنْ تَبِعَ دِينَكُمْ قُلْ إِنَّ الْهُدَى هُدَى اللَّهِ أَنْ يُؤْتَى أَحَدٌ مِثْلَ مَا أُوتِيتُمْ أَوْ يُحَاجُّوكُمْ عِنْدَ رَبِّكُمْ قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (73) يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (74)﴾ [سورة آل عمران: 72-74].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: আহলে কিতাব কর্তৃক দ্বীনকে নিয়ে তামাশা ও আল্লাহর জবাব।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭২। আহলে কিতাবের আরেকটি দল বলে: তোমরা দিনের প্রথম ভাগে তার প্রতি ঈমান গ্রহণ করো, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে মুমিনদের উপর; এবং দিনের শেষ ভাগে তার প্রতি কুফরী করো, হয়তো তারা ফিরে আসবে।
৭৩। আর তোমরা কেবল তাদেরকে বিশ্বাস করো, যারা তোমাদের দ্বীনের অনুসরণ করে; বলো: নিশ্চয় আল্লাহর হেদায়েত হলো একমাত্র হেদায়েত; (তোমরা এ কথাও বিশ্বাস করো না যে) দেওয়া হবে কাউকে তার অনুরুপ যা তোমাদেরকে (ইতঃপূর্বে) দেওয়া হয়েছে, অথবা তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করবে তোমাদের রবের নিকট; বলো: নিশ্চয় সকল অনুগ্রহ আল্লাহর হাতে, তা দান করেন তিনি যাকে চান; আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
৭৪। তাঁর মহমতের সাথে যাকে ইচ্ছা খাস করে নেন; আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে ইহুদীদের তৃতীয় আরেকটি চক্রান্ত হলো- তারা নিজেদের ভিতর আপোস করে নিয়েছিল যে, তারা সকালে মুমিন হয়ে আবার সন্ধায় কাফির হয়ে যাবে। এ থেকে মুসলিমদের অন্তরেও নিজেদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যাবে। তারা ভাববে এরা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেছে, অতএব হতে পারে ইসলামে এমন বহু দোষ-ত্রæটি রয়েছে, যা তারা জানতে পেরে এ ধর্ম ত্যাগ করেছে।
তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে বলতো: তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্ভীদেরকে বিশ্বাস করো না। আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবে বলেছেন: তোমাদের ছলনা ও প্রতারণায় কিছু হবে না; কারণ হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিবেন তোমাদের প্রতারণা তাকে হেদায়েত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে আরো বলতো: তোমরা এ কথা মনে কর না যেই দ্বীন-শরীয়ত এবং জ্ঞান-মর্যাদা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্য কেউ লাভ করতে পারে; অথবা তোমরা ছাড়া অন্য কেউ সত্যের উপর থাকতে পারে, যা দিয়ে আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করে তোমাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত কথার জবাবে বলেন: তাদের জেনে রাখা উচিৎ দ্বীন ও শরীয়ত হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। এটা কারো উত্তরাধিকার সূত্রে লদ্ধ জিনিস নয়, বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করেন, আর এ অনুগ্রহ কাকে দেওয়া উচিৎ, তাও তিনি ভালো জানেন। তিনি হলেন মহা অনুগ্রহশীল। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩২, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿وَجْهَ النَّهَارِ﴾ “দিনের সম্মুখভাগ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সকাল। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৯৫/ তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৭২) ।
﴿آخِرَهُ﴾ “দিনের শেষের ভাগ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- বিকাল। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৯৫/ তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৭২) ।

(৭১-৭৩) আয়াতদ্বয় অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু সাইফ, আদী ইবনু যায়েদ এবং হারিস ইবনু আউফ নামক ইহুদীরা একে অপরকে বলতো: এসো আমরা সকালে মোহাম্মদের উপর অবতীর্ণ হওয়া কিতাবের প্রতি ঈমান আনি এবং বিকালে তা ত্যাগ করি। এতে তাদের দ্বীন সম্পর্কে তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হবে। ফলে, এক পর্যায় তারা তাদের দ্বীন থেকে ফিরে আসবে। তাদের এ চক্রান্তের জবাবে আল্লাহ তায়ালা (৭১-৭৩) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করেন। (লুবাব আল-নুক‚ল ফি আসাবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৫১) ।
পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে হক্ব থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে ইহুদী-খৃষ্টানদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে, আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মুমিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। (৭২-৭৩) আয়াতদ্বয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইহুদী-খৃষ্টানদের তিনটি চক্রান্ত উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) নিজেদেরকে ঈমানদার দাবী করে মুমিনদেরকে ধোকা দেওয়া, তারা নিজেদের ভিতর আপোস করে নিয়েছিল যে, তারা সকালে মুমিন হয়ে আবার সন্ধায় কাফির হয়ে যাবে। এ থেকে মুসলিমদের অন্তরেও নিজেদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যাবে। ফলে, তারা ভাববে এরা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেছে, অতএব হতে পারে ইসলামে এমন বহু দোষ-ত্রæটি রয়েছে, যা তারা জানতে পেরে এ ধর্ম ত্যাগ করেছে।
(খ) নিজেদেরকে ছাড়া অন্য ধর্মের কোন অনুসারীকে বিশ্বাস না করা, তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে বলতো: তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্ভীদেরকে বিশ্বাস করো না। আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবে বলেছেন: তোমাদের ছলনা ও প্রতারণায় কিছু হবে না; কারণ হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিবেন তোমাদের প্রতারণা তাকে হেদায়েত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
(গ) কেবল নিজেদেরকেই হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে দাবী করা, তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে আরো বলতো: তোমরা এ কথা মনে কর না যেই দ্বীন-শরীয়ত এবং জ্ঞান-মর্যাদা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্য কেউ লাভ করতে পারে; অথবা তোমরা ছাড়া অন্য কেউ সত্যের উপর থাকতে পারে, যা দিয়ে আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করে তোমাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত কথার জবাবে বলেন: তাদের জেনে রাখা উচিৎ দ্বীন ও শরীয়ত হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। এটা কারো উত্তরাধিকার সূত্রে লদ্ধ জিনিস নয়, বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করেন, আর এ অনুগ্রহ কাকে দেওয়া উচিৎ, তাও তিনি ভালো জানেন। তিনি হলেন মহা অনুগ্রহশীল। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০-২৬১) ।
২। উল্লেখিত আয়াতাবলীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ধোঁকাবাজি, একগুঁয়েমি এবং অন্যকে বিভ্রান্ত করার হীনতম চরিত্রের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৩) ।
৩। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইহুদীরা মুসলমানদের কোন ধর্মীয় বিষয়কে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। যুগ যুগ ধরে তাদের বংশীয় চরিত্রকে তারা ধারণ করে আসছে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৩) ।
৪। (৭৩-৭৪) আয়াতদ্বয় থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, হেদায়েত এবং কারো উপর দয়ার একক মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা এ দুইটি নেয়ামতের জন্য নির্ধারণ করে থাকেন। (আল্লাহই ভালো জানেন)

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) অন্যকে বিভ্রান্ত অথবা কোন ধরণের ক্ষতি করার জন্য চক্রান্ত না করা।
(খ) নিজের মত অথবা দলকে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে মর্মে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ইহুদীদের চরিত্র।
(গ) হেদায়েত কেবল আল্লাহ তায়ালার কাছে কামনা করা।

 

সূরা আলে-ইমরানের (৬৯-৭১) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: কিছু আহলে কিতাবের দ্বারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ কর্তৃক জবাব।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَدَّتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ (69) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ (70) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَلْبِسُونَ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (71)﴾ [سورة آل عمران: 69-71].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:

কিছু আহলে কিতাবের দ্বারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ কর্তৃক জবাব।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৬৯। আহলে কিতাবের মধ্য থেকে একটি দল কামনা করে, যদি তারা তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারতো! কিন্তু তারা বিভ্রান্ত করছে কেবল নিজেদেরকেই, অথচ তারা অনুভব করে না।
৭০। হে আহলে কিতাব! আল্লাহর আয়াতাবলীকে কেন অস্বীকার করছো? অথচ তোমরাই তার সাক্ষ্য দিচ্ছো।
৭১। হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করছো এবং সত্যকে গোপন করছো, অথচ তোমরা অবগত আছো।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি দল সর্বদা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকানোর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করতে চায়। আল্লাহ তায়ালা তিনটি পদ্ধতিতে তাদের এ হীন আচরণের জবাব দিয়েছেন:
প্রথমত: ঘৃণ্য আচরণের পরিণতি বর্ণনা করার মাধ্যমে, এ কাজের মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করছে। তারা বুঝতে পারছে না যে তাদের এ অপকর্ম মুসলমানদের তো কোন ক্ষতি করতে পারছেই না, বরং এর জন্য তারা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: তাদের চিরাচরিত ঘৃণ্য স্বভাব বর্ণনার মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি কাজ করতো:
(ক) তাওরাত-ইনজীলের যে সকল আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সুসংবাদ এসেছে, তারা কেন সে সকল আয়াতকে অস্বীকার করে? অথচ তারা জানে রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণের সুসংবাদ সত্য।
(খ) তারা কেন তাদের গ্রন্থে বিদ্যমান মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন গুণাবলীকে তাদের বিকৃত মতবাদের সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছে এবং মোহাম্মদ (সা.) এর গুণাবলীকে গোপন রাখার চেষ্টা করছে। অথচ তারা এর হাক্বীকত সম্পর্কে জানেন। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮-৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿طَائِفَةٌ﴾ “একটি দল”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইহুদী এবং খৃষ্টানদের মধ্যে যারা আহবার-রুহবান বা ওলামা রয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৬৯) ।
﴿وَمَا يُضِلُّونَ﴾ “তারা বিভ্রান্ত করে কেবল নিজেদেরকে”, আয়াতাংশে ইদলাল আরবী শব্দ যার অর্থ হলো: বিভ্রান্ত করা বা পথভ্রষ্ট করা। এর আরেকটি অর্থ হলো: ধ্বংস করা। ইমাম তবারী (র.) বলেন: অত্র আয়াতে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে এসেছে। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৫০০) ।
﴿بِآيَاتِ اللَّهِ﴾ “আল্লাহর আয়াতাবলীর প্রতি”, আয়াতাংশে আল্লাহর আয়াতাবলী দ্বারা ঐ সকল আয়াতাবলীকে বুঝানো হয়েছে যে সকল আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণের সুসংবাদ এবং তার গুণাবলী নিয়ে কথা বলা হয়েছে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২২) ।
﴿الْحَقّ﴾ “সত্য”, আয়াতের দুই জায়গাতেই ‘সত্য’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: রাসূলুল্লাহর (সা.) গুণাবলী, যা তাওরাতে এসেছে। (তাফসীর ইবনু কাছীর: ২/৫৯) ।
﴿بِالْبَاطِلِ﴾ “বাতিলের সাথে”, আয়াতাংশে বাতিল দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: তাহরীফ বা বিকৃতিকরণ। যেহেতু তারা রাসূলুল্লাহর গুণাবলী ও সুসংবাদ সম্বলিত আয়াতাবলীকে বিকৃত করেছিল। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২৩) ।

(৬৯) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
মুয়াজ ইবনু জাবাল, আম্মার ইবনু ইয়সির এবং হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে যখন ইহুদীরা তাদের ধর্মের দিকে আহবান করেছিল, তখন তাদের সম্পর্কে উনসত্তর নাম্বার আয়াতঅবতীর্ণ হয়েছে। (আসবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১১১) ।

পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে হক্ব থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে তাদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে, আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মুমিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। উনসত্তর নাম্বার আয়াতে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানরা সর্বদা হিংসার বশবর্তী হয়ে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করতে চায়। যেমন: এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمانِكُمْ كُفَّاراً حَسَداً مِنْ عِنْدِ أنْفُسِهِمْ﴾ [سورة البقرة: ১০৯].
অর্থাৎ: “অনেক ইহুদী-খৃষ্টানরা তোমাদের ঈমান গ্রহণের পরেও হিংসার বশবর্তী হয়ে পুণরায় আবার তোমাদেরকে কুফরীর দিকে ফিরিয়ে আনতে চায়” (সূরা বাক্বারা: ১০৯) ।
(খ) ইহুদী-খৃষ্টানরা শত চেষ্টা করেও মুসলমানদেরকে গোমরাহ করতে পারে নাই, বরং নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।
(গ) অন্যকে ক্ষতি করার জন্য গর্ত খনন করলে, অজান্তে সে নিজেই সেই গর্তে পতিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩৩০) ।
২। উল্লেখিত তিনটি আয়াতে যারা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকানোর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করতে চায়, তিনটি পদ্ধতিতে আল্লাহ তায়ালা তাদের এ হীন আচরণের জবাব দিয়েছেন:
প্রথমত: ঘৃণ্য আচরণের পরিণতি বর্ণনা করার মাধ্যমে, এ কাজের মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করছে।
দ্বিতীয়ত: তাদের চিরাচরিত ঘৃণ্য স্বভাব বর্ণনা পূর্বক তিরস্কার করার মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি কাজ করে থাকে:
(ক) তাওরাত-ইনজীলের যে সকল আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সুসংবাদ এসেছে, তারা জেনে বুঝে সে সকল আয়াতকে কেন অস্বীকার করে থাকে?
(খ) তারা তাদের গ্রন্থে বিদ্যমান মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন গুণাবলীকে তাদের বিকৃত মতবাদের সাথে কেন মিশ্রিত করে ফেলে এবং তা গোপন রাখার চেষ্টা করে কেন? (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮-৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) । সুতরাং মুসলমানগণ যেন তাদের বিভ্রান্তিমূলক আচরণে বিব্রতবোধ না করে।
৩। সত্তর নাম্বার আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবী হওয়ার সত্যতার প্রমাণ রয়েছে; কারণ তাওরাতে তার আগমণের সুসংবাদ থাকার বিষয়ে তিনি সংবাদ দিয়েছেন। অথচ তিনি লেখাপড়া জানতেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে এ বিষয়ে সংবাদ না দিলে তিনি তা জানতে পারতেন না। সুতরাং বুঝা যায় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী ও রাসূল। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৫৬) ।
৪। একাত্তর নাম্বার আয়াতে ইহুদী আলেমদের সাধারণ মানুষের সাথে তামাশাপূর্বক তাওরাতের বাণীকে গোপন রাখার মাধ্যমে তা বিকৃতি করার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা যতগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করে তাওরাতকে বিকৃতি করেছিল তার অন্যতম হলো: (ক) তাওরাতের বিধানকে তাদের মনগড়া ও সুবিধানুযায়ী কিছু বিধানের সাথে মিশ্রণ করা এবং (খ) তাওরাতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণ সম্পর্কিত কথাগুলো গোপন রাখা।
একজন আলেমের দায়িত্ব হলো আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাবে যা বলেছেন তা কোন ধরণের পরিবর্তন-পরিবর্ধন, মিশ্রন এবং গোপন করা ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা বাতিলকে সত্য থেকে, হারামকে হালাল থেকে এবং অপবিত্রতাকে পবিত্রতা থেকে পার্থক্য করতে পারে। অন্যথায় মানুষের বিশাল অংশ আল্লাহ প্রদত্ব অহীর জ্ঞান তথা হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে। (তাফসীর সা’দী: ১৩৪) ।
৫। ইহুদী-খৃষ্টানরা দুইটি কাজ করতো এবং এখনও করে: (ক) তারা মোহাম্মদকে (সা.) নবী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং (খ) তারা মোহাম্মদের (সা.) নবী হওয়া ও ইসলামের মৌলিক বিষয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাতে সন্দেহ প্রবেশ করিয়ে থাকে। সত্তর নাম্বার আয়াতে তাদের প্রথম স্বভাব থেকে এবং একাত্তর নাম্বার আয়াতে দ্বিতীয় স্বভাব থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৫৬) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) অন্যকে বিভ্রান্ত অথবা কোন ধরণের ক্ষতি না করা।
(খ) রাসূলুল্লাহকে (সা.) নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নেওয়া।
(গ) আলেম সর্বদা কোরআন-সুন্নাহের বাণী কোন ধরণের অপব্যাখ্যা ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিবে।

সূরা আলে-ইমরানের (৬৪-৬৮) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদের ডাক।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ (64) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تُحَاجُّونَ فِي إِبْرَاهِيمَ وَمَا أُنْزِلَتِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ إِلَّا مِنْ بَعْدِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (65) هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (66) مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (67) إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ (68)﴾ [سورة آل عمران: 64-68].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদের ডাক।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ ও শব্দার্থ:
৬৪ হে আল্লাহর রাসূল! তুমি বলো: হে আহলে কিতাব! এসো এমন কালেমার দিকে যা আমাদের মধ্যে এবং তোমাদের মধ্যে সমান; (তা এই যে) আমরা ইবাদত করব না আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো, শরীক করবো না তাঁর সাথে কাউকে এবং আমাদের কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবো না। আর যদি তারা বিমুখ হয়, তাহলে তোমরা বলো: তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।
৬৫। হে আহলে কিতাব! কেন বিতর্ক করছো ইব্রাহীমকে নিয়ে? অথচ তাওরাত ও ইনজীল অবতীর্ণ হয়েছিলো তার আগমণের পরে, তোমরা কি বুঝবে না?
৬৬। সাবধান! তোমরা তো সে সব লোক যারা বিতর্ক করছো এমন বিষয়ে, যে সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান রয়েছে; তাহলে তোমরা কেন বিতর্ক করছো এমন বিষয়ে, যার জ্ঞান তোমাদের নেই; আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না।
৬৭। ইব্রাহীম ইহুদীও ছিলো না এবং খৃষ্টানও ছিলো না, বরং সে ছিলো একনিষ্ঠ মুসলিম, আর সে ছিলো না মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত।
৬৮। নিশ্চয় ইব্রাহীমের সবচেয়ে নিকটবর্তী মানুষ হলো যারা তার অনুসরণ করেছে এবং এই নবীর ও মুমিনগণ; আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) মাধ্যমে আহলে কিতাবকে তাওহীদের কালেমার দিকে আহবান করেছেন, যার অনুসরণ করা মুসলিম, খৃষ্টান ও ইহুদী নির্বিশেষে সকলের জন্য কর্তব্য। আর তাওহীদের কালেমা হলো: (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) নিজেদের মধ্যে কাউকে বিভিন্ন উপাদিতে ভ‚ষিত করে রবের স্থানে না বসানো। আর যদি তারা এ দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে যেন মুসলিমরা তাদেরকে সাক্ষী রেখে নিজেদেরকে মুসলিম হওয়ার ঘোষণা দেয়।
ইহুদী-খৃষ্টানরা দাবী করতো ইব্রাহীম (আ.) তাদের ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) মাধ্যমে তাদের এ অযৌক্তিক দাবীর জবাব দেন। তারা কিভাবে ইব্রাহীমকে (আ.) ইহুদী অথবা খৃষ্টান হওয়ার দাবী করে? অথচ ইব্রাহীমের (আ.) আগমণ হয়েছে তাদের চেয়ে হাজার হাজার বছর পূর্বে। তারা নিজেদের দাবীর ব্যাপারে অন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা কি বলছে? তা উপলব্দি করতে পারছে না।
তারা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তাদের ধর্মীয় বিষয়, যা সম্পর্কে তারা ধারণা রাখে, সে বিষয়ে তর্ক করলে তা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তারা কেন ইব্রাহীমের (আ.) বিষয়ে তর্ক করে? যার সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা যে বিষয়ে তর্ক করে তার হাকীকত সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না, বরং আল্লাহ তায়ালাই সাম্যক জ্ঞাত।
আসল কথা হলো: ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী অথবা খৃষ্টান কোনটাই ছিলেন না; কারণ তিনি ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম আসার বহু পূর্বে এসেছেন। বরং তিনি ছিলেন আল্লাহ তায়ালার একান্ত অনুসারী এবং তিনি মুশরিকদের দলভুক্তও ছিলেন না।
তিন শ্রেণীর মানুষ ইব্রাহীমের (আ.) আপনজন: (ক) যারা তার অনুসরণ করেছে, (খ) যারা মোহাম্মদের (সা.) অনুসরণ করে এবং (খ) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে। আর আল্লাহ হলেন মুমিনদের অভিভাবক এবং কাফেরৃ-মুশরিকদের শত্রæ। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩২৮, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿أَهْلَ الْكِتَابِ﴾ “আহলুল কিতবা”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইহুদী এবং খৃষ্টান জাতি; কারণ ইহুদীদের উপর তাওরাত এবং খৃষ্টানদের উপর ইনজীল অবতীর্ণ হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩২৭) ।
﴿كَلِمَةٍ سَوَاءٍ﴾ “সাম্যের বাণী”, আয়াতাংশ দ্বারা তাওহীদের কালেমাকে বুঝানো হয়েছে, যা তিনটি বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করে: (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) নিজেদের মধ্যে কাউকে বিভিন্ন উপাদিতে ভ‚ষিত করে রবের স্থানে না বসানো। (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
﴿أَرْبَابًا﴾ “রবসমূহ”, আয়াতাংশে ‘আরবাব’ শব্দটি আরবী, যা ‘রব’ শব্দের বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহর অনুসরণ বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অনুসরণীয় মাবুদ বানানো। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩২৭) ।
﴿حَنِيفاً مُسْلِماً﴾ “একনিষ্ঠ মুসলিম”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: বাতিল ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে সত্য ধর্মের দিকে ফিরে আসা। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩২৭) ।

(৬৫-৬৭) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নাজরান থেকে খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে দাবী করলো যে ইব্রাহীম (আ.) খৃষ্টান ছিলেন এবং ইহুদী আহবাররা দাবী করলো যে ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী ছিলেন। তাদের এ ভ্রান্ত দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার (৬৫-৬৭) আয়াতাবলী অবতীর্ণ করেন। (আসবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৬৩-৬৪) ।
ইহুদীরা রাসূলুল্লাহকে (সা.) বললো: ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী হওয়ার কারণে আমরা তোমাদের চেয়ে তার বেশী নিকটবর্তী। আর এগুলো দেখে তুমি আমাদের সাথে হিংসা করে বেড়াচ্ছো। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র সূরার ৬৮ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করে ইব্রহীমের (আ.) প্রকৃত আপনজন সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫১) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। চৌষাট্টি নাম্বার আয়াতে চারটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) অত্র আয়াতে ইহুদী-খৃষ্টান সহ সকল আহলে কিতাবকে সম্বোধন করা হয়েছে; কারণ তারা তাদের আলেমদেরকে রব বানিয়েছে। একবার রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলা হলো তারা তো তাদের আলেমদের ইবাদত করে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন তারা কি তাদের আলেমগণ আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মধ্যে যা হালাল করে তাকে হালাল মনে করে এবং হালালকৃত বস্তু যা হারাম করে তাকে হারাম মনে করে? সাহাবায়ে কিরাম বললেন: হ্যা, ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন: এটাই ইবাদতের নাম্বান্তর। (সুনান আল-তিরমিযী: ৩০৯৫, হাদীসটি হাসান) । এ সম্পর্কে সূরা তাওবার একত্রিশ নাম্বার আয়াতে বর্ণনা এসেছে, সেখানে বলা হয়েছে:
﴿اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾ [سورة التوبة: ৩১].
অর্থাৎ: “তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আহবার ও রুহবানদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও। অথচ তারা আদিষ্ট হয়েছিল কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করতে যিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই, তারা যে শিরক করে তা থেকে আল্লাহ পুতপবিত্র” (সূরা তাওবা: ৩১) ।
(খ) আয়াতে তাওহীদের কালেমা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) নিজেদের মধ্যে কাউকে বিভিন্ন উপাদিতে ভ‚ষিত করে রবের স্থানে না বসানো। (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
(গ) যারা ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে একজন মুসলিম তাদেরকে নিজের মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষী রেখে তাদেরকে তাদের পথে ছেড়ে দিবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৩) ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সা.) রোম, পারস্য এবং হাবশা সহ যত দেশের রাজা-বাদশাহের কাছে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠিয়েছেন অত্র আয়াত তার সারমর্ম। যেমন: সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রোম স¤্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে পাঠানো চিঠিটি উল্লেখযোগ্য, যেখানে বলা হয়েছে:
“بسم الله الرّحمن الرّحيم. من محمد رسول الله إلى هرقل عظيم الرّوم. سلام على من اتّبع الهدى، أما بعد: فإني أدعوك بدعاية الإسلام، أسلم تسلم، وأسلم يؤتك الله أجرك مرتين، فإن توليت، فإن عليك إثم الأريسيين- أي الشعب من فلاحين وخدم وأتباع وغيرهم، ويا أَهْلَ الْكِتابِ تَعالَوْا إِلى كَلِمَةٍ سَواءٍ بَيْنَنا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ، وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئاً، وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنا بَعْضاً أَرْباباً مِنْ دُونِ اللَّهِ، فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا: اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ”.
অর্থাৎ: “পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। আল্লাহর রাসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে রোম স¤্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে। হেদাকামীদের প্রতি আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে ইসলামের দিকে দাওয়াত করছি। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনিও ইসলাম গ্রহণ করুন। আপনি ইসলাম গ্রহণ করলে দ্বিগুণ সাওয়াব প্রদান করা হবে। আর যদি প্রত্যাক্ষ্যান করেন, তাহলে আপনার দেশের জনগণের পাপের বোঝাও আপনাকে বহণ করতে হবে। অতঃপর অত্র আয়াতটি উল্লেখ করলেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৩) ।
(ঘ) উল্লেখিত আয়াতে দুই প্রকার তাওহীদের বর্ণনা এসেছে: (ক) “আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করি” আয়াতাংশ দ্বারা ‘তাওহীদ আল-উলুহিয়্যাহ’ এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (খ) “আমরা যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি” আয়াতাংশ দ্বারা ‘তাওহীদ আল-রুবুবিয়্যাহ’ এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে সকল নবী-রাসূলগণ মানবজাতিকে তাওহীদের দিকে আহবান করেছেন। যেমন: আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন:
﴿وَما أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ: لا إِلهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾ [سورة الأنبياء: ২৫].
অর্থাৎ: “আমি আপনার পূর্বের সকল নবীকে এই মর্মে অহী প্রদান করেছি যে, আমি ছাড়া কোন হক্ব ইলাহ নেই, অতএব তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করো” (সূরা আল-আনবিয়া: ২৫) ।
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ، وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾ [سورة النحل: ৩৬].
অর্থাৎ: “অবশ্যই আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছে এ নির্দেশ দিয়ে রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা কেবল আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে পরিহার করো” (আল-নাহল: ৩৬) ।
২। ইহুদী-খৃষ্টানদের দাবী ইব্রাহীম (আ.) ইহুদী অথবা খৃষ্টান ছিলেন। তাদের এ ভ্রান্ত দাবীর জবাবে আল্লাহ তায়ালা (৬৫-৬৮) আয়াতে সংলাপমূলক পদ্ধতিতে প্রমাণ করেছেন যে তিনি ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুশরিক কোনটিই ছিলেন না:
প্রথমত: আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি আল-সুয়াল আল-ইজবারী বা বাধ্যতামূলক প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছেন, তারা কিভাবে ইব্রাহীমকে (আ.) ইহুদী-খৃষ্টান হওয়ার দাবী করতে পারে, অথচ তার আগমণ হয়েছে ইহুদী-খৃষ্টান নামে দুইটি ধর্মের প্রবর্তনের অনেক আগে?
দ্বিতিয়ত: তাদের বোকামী ও অজ্ঞতাকে প্রকাশ করে দিয়েছেন, মূসা এবং ঈসা (আ.) সম্পর্কে তাদের জানা থাকার কারণে কথা বলাতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু তারা কিভাবে ইব্রাহীমকে (আ.) নিয়ে কথা বলে, যার সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই।
তৃতীয়ত: ইব্রাহীম (আ.) আসলে কোন ধর্মের ছিলেন, সে বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে দিয়েছেন, তিনি ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুশরিক কোনটারই অনুসারী ছিলেন না, বরং তিনি একজন খাটি আল্লাহর অনুসারী ছিলেন।
চত‚র্থত: ইব্রাহীমের (আ.) সাথে কাদের সুসম্পর্ক বেশী তা প্রকাশ করেছেন, তার সাথে ইহুদী, খৃষ্টান ও মুশরিকদের কোন সম্পর্ক নেই, বরং সম্পর্কের দিক থেকে তার আপনজন হলো তিন শ্রেনীর মানুষ: (ক) যারা তার অনুসরণ করেছে, (খ) যারা মোহাম্মদের (সা.) অনুসরণ করে এবং (খ) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৫) ।
৩। উল্লেখিত আয়াতাবলী থেকে বুঝা যায় সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনে তর্ক করা ওয়াজিব। এ সম্পর্কে সূরা নাহল এর ১২৫ নাম্বার আয়াত সহ আরো অনেক আয়াত রয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৫৭) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) একজন দায়ী সর্বদা মানবজাতিকে তাওহীদের দিকে আহবান করবে।
(খ) সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনে তর্ক করা যাবে।
(গ) যে বিষয়ের জ্ঞান রয়েছে, কেবল সে বিষয়ে তর্ক করা যাবে।

সূরা আলে-ইমরানের (৫৯-৬৩) আয়াতাবলীর তাফসীর, আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: যারা ঈসাকে (আ.) ইলাহ হওয়ার ভ্রান্ত দাবী করে তাদের জবাব এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় ‘মুবাহালা’ পদ্ধতির আবির্ভাব।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِنْدَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (59) الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُنْ مِنَ الْمُمْتَرِينَ (60) فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ (61) إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلَهٍ إِلَّا اللَّهُ وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (62) فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِالْمُفْسِدِينَ (63) ﴾ [سورة آل عمران:59-63].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: যারা ঈসাকে (আ.) ইলাহ হওয়ার ভ্রান্ত দাবী করে তাদের জবাব এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় ‘মুবাহালা’ পদ্ধতির আবির্ভাব।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৫৯। নিশ্চয় ঈসার দৃষ্টান্ত আল্লাহর নিকট আদমের মতো; তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা, অতঃপর তাকে বললেন: হও, ফলে তা হয়ে গেল।
৬০। (এ) সত্য (এসেছে) তোমার রবের পক্ষ থেকে, সুতরাং তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না ।
৬১। অতঃপর যে তোমার সাথে তর্ক করে এ বিষয়ে তোমার কাছে জ্ঞান আসার পরে, তবে তাকে বলো: এসো! ডেকে নেই আমাদের সন্তানদেরকে ও তোমাদের সন্তানদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে এবং সয়ং আমাদেরকে ও সয়ং তোমাদেরকে, অতঃপর আমরা ‘মুবাহালা’ করি যে, “আল্লাহর অভিশাপ হোক মিথ্যাবাদীদের উপর”।
৬২। নিশ্চয় এটি সত্য বিবরণ, আর কোন (সত্য) ইলাহ নেই আল্লাহ ছাড়া, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
৬৩। তবুও যদি তারা উপেক্ষা করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ অবগত আছেন ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ঈসা (আ.) স্বাভাবিক পদ্ধতির বিপরীতে পিতা বিহীন সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাকে আল্লাহর পুত্র ও ইলাহ দাবী করে খৃষ্টানরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত দাবীর জবাবে বলেন: ঈসার (আ.) দৃষ্টান্ত আদমের (আ.) মতো, তাকে তিনি সরাসরি মাটি থেকে পিতামাতা বিহীন সৃষ্টি করেছেন। পিতা বিহীন সৃষ্টি হওয়ার কারণে ঈসাকে (আ.) ইলাহের আসনে বসানো অযৌক্তিক এবং বতিল; কারণ আদম (আ.) পিতমাতা বিহীন সৃষ্টি হওয়ার পরেও তারে তো কেউ ‘ইলাহ’ বলে না। সুতরাং এ ভ্রান্ত দাবি থেকে তাদের ফিরে আসা উচিৎ।
আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে (সা.) শান্তনা প্রদান পূর্বক বলেছেন: ঈসার (আ.) ব্যাপারে তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে তাই সত্য। সুতরাং তার উপর তিনটি করণীয়:
(ক) ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র এবং ইলাহ নয় এ কথা বিশ্বাস করা।
(খ) ঈসার (আ.) ব্যাপারে খৃষ্টানদের মিথ্যাচারিতাকে বর্জন করা।
(গ) তার ব্যাপারে আল্লাহ প্রদত্ব সংবাদের প্রতি সন্দেহ পোষণ না করা।
ঈসার (আ.) সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা আসার পরেও যারা তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তর্কে জড়াবে, তাদেরকে ‘মুবাহালা’ এর দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। আর ‘মুবাহালা’ হলো: কোন বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে দুই গ্রুপের লোকজন তাদের সন্তানসন্তুতি এবং স্ত্রীপরিজনকে সাথে নিয়ে আল্লাহর কাছে এ মর্মে প্রার্থণা করা যে, যারা মিথ্যাবাদী তাদের উপর যেন আল্লাহ তায়ালা লা’নত বর্ষণ করেন।
আল্লাহ তায়ালা আবারও তাঁর রাসূলকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলেছেন: ঈসার (আ.) ব্যাপার যে ঘটনা বর্ণনা করা হলো তাই সত্য। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। নিশ্চয় তিনি মহপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
অবশেষে আল্লাহ তায়ালা চুড়ান্তভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, খৃষ্টানরা যদি ঈসার (আ.) ব্যাপারে রাসূলুল্লাহর (সা.) সংবাদকে অস্বীকার করে এবং তার অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারাই যমীনে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত এবং সে অনুযায়ী কিয়ামতে প্রতিদান দিবেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৭৩-১৭৪, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩২৫-৩২৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭-৫৮, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৪-৯৫) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْحَقُّ﴾ “সত্য”, শব্দটির পূর্বে ‘উহা’ অথবা ‘ইহা’ সর্বনাম উহ্য রয়েছে। আয়াতাংশের অর্থ হলো: ইহা সত্য। আর ‘ইহা’ সর্বনামটি পূর্ববর্তী আয়াতে যে ঈসা (আ.) এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, সে দিকে ফিরেছে। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: বর্ণিত ঘটনা সত্য। (মায়ানী আল-কোরআন, ফাররা: ১/২২০) ।
﴿فَلَا تَكُنْ﴾ “সুতরাং তুমি হয়ো না”, আয়াতাংশে রাসূলুল্লাহকে (সা.) সম্বোধন করা হলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তার উম্মত; কারণ তিনি ঈসার (আ.) এর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেননি। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৬০) ।
﴿الْعِلْمِ﴾ “জ্ঞান”, আয়াংশে ‘জ্ঞান’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘ঈসা’ (আ.) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রসূল হওয়ার বিষয়ের জ্ঞান। (তাফসীর সা’দী: ১৩৩) ।
﴿وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ﴾ “সয়ং আমরা এবং তোমরা”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আমাদের ভাইয়েরা এবং তোমাদের ভাইয়েরা। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবাহ: ১/৯৫) ।
﴿نَبْتَهِلْ﴾ ‘আমরা মুবাহালা করি’, ‘মুবাহালা’ হলো: কোন বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে দুই গ্রæপের লোকজন তাদের সন্তানসন্তুতি এবং স্ত্রীপরিজনকে সাথে নিয়ে আল্লাহর কাছে এ মর্মে প্রার্থণা করা যে, যারা মিথ্যাবাদী তাদের উপর যেন আল্লাহ তায়ালা লা’নত বর্ষণ করেন। (সূরা আলে-ইমরান: ৬১) ।
﴿هَذَا﴾ ‘ইহা’, আয়াতাংশে ‘ইহা’ সর্বনামটি ‘ঈসা’ (আ.) এর ইলাহ হওয়ার অযৌক্তিক দাবীকে খন্ডন করার জন্য পূর্ববর্তী আয়াতাবলীতে যে ঘটনাসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে, সে দিকে ফিরেছে। (তাফসীর সা’দী: ১৩৩) ।

পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসা এবং মারইয়ামের (আ.) কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি ঈসার (আ.) কওমের একাংশ তার প্রতি ঈমান গ্রহণ ও আরেকাংশ তার প্রতি কুফরি করার বিষয়ে বর্ণনা এসেছে। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে তৃতীয় আরেকটি গ্রæপের বর্ণনা এসেছে, যারা তার প্রতি কুফরী করেনি, বরং তিনি পিতা বিহীন অলৌকিকভাবে জন্ম গ্রহণ করার কারণে তার প্রতি অশুদ্ধ ঈমান আনায়নের মাধ্যমে ফিতনায় পতিত হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৪৬) ।

(৫৯-৬২) নং আয়াতাবলী অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইবনু সাঈদ (র.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে নাজরান থেকে দুইজন খৃষ্টান পাদ্রী আসলে তিনি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। উত্তরে তারা বলে: আমরা তোমার পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: তিনটি কারণে তোমরা মুসলিম নয়: (ক) তোমরা আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করেছো, (খ) তোমরা শুকরের গোস্ত ভক্ষণ করে থাকো এবং (গ) তোমরা মুর্তিকে সাজদা করে থাকো। উত্তরে তারা বলে: তাহলে ঈসার (আ.) পিতা কে? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর প্রদানে তাড়াহুড়া না করে তার রবের পক্ষ থেকে অহীর অপেক্ষা করলে আল্লাহ তায়ালা (৫৯-৬২) আয়াতাবলী অবতীর্ণ করেছেন। (আসবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৬৩) ।

৫৯ নং আয়াতে বর্ণিত উপমার ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো: অদৃশ্য বা অস্পষ্ট বিষয়কে দৃশ্যমান বা অধিক স্পষ্ট বিষয়ের সাথে উপমা দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া। লক্ষনীয় যে, বালাগাতের পরিভাষায় একটি উপমাতে চারটি বিষয় থাকে: (ক) যাকে উপমা দেওয়া হয়, (খ) যার সাথে উপমা দেওয়া হয়, (গ) উপমা দেওয়ার হরফ এবং (ঘ) উপমার উদ্দেশ্য। বালাগাতের আলোকে ৫৯ নাম্বার আয়াতে বর্ণিত উপমার ব্যখ্যা হলো:
 যাকে উপমা দেওয়া হয়েছে: ঈসার (আ.) সৃষ্টি পদ্ধতি।
 যার সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে: আদমের (আ.) সৃষ্টি পদ্ধতি।
 উপমা প্রদানের হরফ: (كَمَثَل) ‘কামাছালি’ (মত)।
 উপমা প্রদানের উদ্দেশ্য: বিস্ময়কর হওয়া।
অর্থাৎ: বিস্ময়কর হওয়ার দৃষ্টিকোন থেকে ঈসার (আ.) সৃষ্টি পদ্ধতি আদমের (আ.) সৃষ্টি পদ্ধতির মতো। আদমকে (আ.) যেমন পিতামাতা বিহীন বিস্ময়করভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনিভাবে ঈসাকে (আ.) পিতা বিহীন অলৌকিকভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। (ফাতহুল কাদীর, শাওকানী: ১/৩৯৭) ।
৬১ নাম্বার আয়াত সংশ্লিষ্ট ঘটনা:
নাজরান থেকে খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে ঈসা (আ.) ইলাহ ও আল্লাহর পুত্র হওয়ার মতো জঘণ্য ও অযৌক্তিক কথবার্তা বলতে শুরু করলে তিনি তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ অথবা ‘মুবাহালা’ অথবা জিযিয়া প্রদান, এই তিনটির যে কোন একটি গ্রহণ করার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ শেষে তৃতীয়টি অর্থাৎ জিযিয়া প্রদানকে প্রাধান্য দিয়ে এলাকায় ফিরে প্রতি বছর দুইবার জিযিয়া আদায় করতে থাকে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/১০৪) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। উনষাট নাম্বার আয়াতে যারা ঈসাকে ‘ইলাহ’ মনে করে আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত দাবীর জবাবে বলেন: ঈসার (আ.) দৃষ্টান্ত তো আদমের (আ.) সাদৃশ, তাকে তিনি সরাসরি মাটি থেকে পিতামাতা বিহীন সৃষ্টি করেছেন। সকল তাফসীরকারকের মতে, পিতা বিহীন অলৌকিকভাবে সৃষ্টি হওয়ার কারণে ঈসাকে (আ.) ইলাহের আসনে বসানো অযৌক্তিক এবং বতিল। তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেওয়া হয় যে কেউ পিতা অথবা মাতা বিহীন অলৌকিকভাবে সৃষ্টি হলে তাকে ইলাহের আসনে বসানো যাবে, তাহলে আদম (আ.) এ আসনে বসার জন্য অধিকতর উপযুক্ত ছিল; কারণ তাকে অলৌকিকভাবে পিতমাতা বিহীন সৃষ্টি করা হয়েছে আর ঈসাকে (আ.) শুধু পিতা বিহীন সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ আদমকে তো কেউ ‘ইলাহ’ বলে না। সুতরাং এ ভ্রান্ত দাবি থেকে তাদের ফিরে আসা উচিৎ। (তাফসীর ইবনু কাছীর: ২/৪৯) ।
২। ষাট নাম্বার আয়াত থেকে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ঈসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যে তথ্য প্রকাশ করেছেন তাই সত্য।
(খ) আল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত এ সত্যকে মেনে নেওয়ার জন্য সকলকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। (তাফসীর সা’দী: ১/১৩৩) ।
৩। একষাট্টি নাম্বার আয়াত থেকে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ‘মুবাহালা’কে কিয়ামত পর্যন্ত শরিয়াতভূক্ত করা হয়েছে। এর জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে: (ক) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া, (খ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত বিষয়ে ‘মুবাহালা’ করা, (গ) বিরোধী গ্রæপ তাদের মতের উপর অটল থাকা এবং (ঘ) বিষয়টি দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। (ইসলাম সাওয়াল-জাওয়াব পেইজ থেকে) ।
(খ) উল্লেখিত আয়াতের মাধ্যমে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি আল্লাহর রিসালাতের সত্যতা প্রমাণিত হয়; কারণ তিনি খৃষ্টানদেরকে ‘মুবাহালা’ এর দিকে আহবান করলে তারা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ‘জিযিয়া’ প্রদানপূর্বক বস্যতা স্বীকারকে গ্রহণ করেছিল। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/১০৪) ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘মুবাহালা’ এর জন্য তার দুই নাতিন হাসান ও হোসাইনকে ইবনি বা আমার সন্তান বলে সম্বোধন করেছেন। এ হাদীসের আলোকে ইমাম শাফেয়ী (র.) মনে করেন কেউ যদি বলে আমি অমুকের সন্তানের জন্য অসিয়াত করলাম। এ ক্ষেত্রে তার ঔরষজাত সন্তান না থাকলে তার নাতিনের উপর অসিয়াত বার্তাবে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/১০৪) ।
৪। বাষাট্টি এবং তেষাট্টি নাম্বার আয়াতে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ঈসা (আ.) নিজে ইলাহ নয়, আল্লাহর পুত্র নয় এবং তিন ইলাহের এক ইলাহও নয়, এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ঈসার (আ.) জীবনী বর্ণনা পূর্বক যে দলীল পেশ করেছেন তা সত্য। এ কথা নিশ্চিতকরণের জন্য ষাট নাম্বার আয়াতের পর বাষাট্টি নাম্বার আয়াতে তা দ্বিতীয় বার উল্লেখ করেছেন।
(খ) দুইটি কারণে আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র ইলাহ বা মা’বূদ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন: (ক) তাঁর ক্ষমতা দুনিয়ার সকল ক্ষমতার শীর্ষে এবং (খ) তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞার সমতুল্য দুনিয়ার কারো প্রজ্ঞা নেই।
(গ) ঈসার (আ.) ব্যাপারে আল্লাহ প্রদত্ব তথ্যকে যারা অস্বীকার করবে তারাই সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিগণিত হবে। (তাফসীর সা’দী: ১/১৩৩, আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩২৬) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ঈসা (আ.) নিজে ইলাহ নয়, আল্লাহর পুত্র নয় এবং তিন ইলাহের এক ইলাহও নয়, এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা।
(খ) সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য উল্লেখিত শর্তের আলোকে ‘মুবাহালা’ এর আয়োজন করা।
(গ) ঈসার (আ.) প্রতি ভ্রান্ত ধারনা পোষণ পূর্বক যমীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৫২-৫৮) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: ঈসা (আ.) এর সাথে তার কওমের ঘটনা।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللَّهِ آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ (52) رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنْزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ (53) وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ (54) إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (55) فَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (56) وَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (57) ذَلِكَ نَتْلُوهُ عَلَيْكَ مِنَ الْآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ (58)﴾ [سورة آل عمران:52-58].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: ঈসা (আ.) এর সাথে তার কওমের ঘটনা।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৫২। অতঃপর যখন ঈসা তার কওমের পক্ষ থেকে কুফরী উপলব্ধি করলো, তখন সে বললো: কারা হবে আমার সাহায্যকারী আল্লাহর পথে? হাওয়ারীগণ উত্তর দিলো: আমরাই হবো আল্লাহর সাহায্যকারী, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আর তুমি সাক্ষী থাকো যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।
৫৩। হে আমাদের রব! আমরা ঈমান আনয়ন করেছি তার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন এবং অনুসরণ করেছি রাসূলের, অতএব আমাদেরকে তালিকাভুক্ত করুন সাক্ষ্যদাতাদের।
৫৪। আর তারা কুটকৌশল করেছে এবং আল্লাহ কৌশল করেছেন, আর আল্লাহ হলেন উত্তম কৌশলী।
৫৫। (স্মরণ করো) যখন আল্লাহ বললেন: হে ঈসা! নিশ্চয় আমি তোমার নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ করবো, তোমাকে আমার কাছে উঠিয়ে নিবো এবং তোমাকে পবিত্র করবো কাফেরদের থেকে। আর আমি কিয়ামত পর্যন্ত তোমার অনুসারীদেরকে কাফিরদের উপর সম্মানিত করবো, অতঃপর আমারই দিকে তোমাদের পত্যাবর্তন হবে। তখন আমি তোমাদের মধ্যে মিমাংসা করবো যে বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।
৫৬। অতঃপর যারা কুফরী করেছে, তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন আযাব দিবো, এবং তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না ।
৫৭। আর যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং সৎআমল করেছে তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে তাদের প্রতিদান দিবেন । আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না ।
৫৮। যা আমি তোমার কাছে তেলাওয়াত করছি, তা হলো: আয়াত এবং হিকমতপূর্ণ উপদেশ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ঈসা (আ.) দাওয়াতী কাজে বের হয়ে তার প্রতি ইহুদী সম্প্রদায়ের অস্বীকৃতি এবং তাকে হত্যার বিষয়ে আঁচ করতে পেরে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন তাদের মধ্যে কারা আছে এ বিপদ মুহুর্তে আল্লাহর পথে তার সাহায্যকারী হবে? তখন তার বিশ্বস্ত সহচরবৃন্দ তার ডাকে সারা দিয়ে আল্লাহর পথে সাহায্যকারী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তারা আরো ঘোষণা করেছিলেন: “আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আর আপনি সাক্ষী থাকুন আল্লাহর একাত্ববাদ ও অনুসরণকে মেনে নিয়েই আমরা মুসলিম হয়েছি”।
হাওয়ারীগণ তাদের মুসলিম হওয়ার বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা দিলেন: “হে আমাদের রব! আমরা ইনজীলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং ঈসাকে (আ.) রাসূল হিসেবে অনুসরণ করব মর্মে ওয়াদা করেছি। অতএব আপনি ঈসা (আ.) এর তাবলীগের মিশন যথার্থভাবে পালন করা এবং ইহুদী সম্প্রদায় কর্তৃক তাকে অস্বীকার করার ব্যাপারে আমাদেরকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করুন, যেমনিভাবে উম্মতে মোহাম্মাদীকে তাদের নবীর দাওয়াতী কাজের পূর্ণতা এবং কাফেরদের অস্বীকৃতির ব্যাপারে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করবেন”।
আর যারা ঈসাকে (আ.) অস্বীকার করেছিল, তারা তাকে জোরপূর্বক ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার জন্য একজনকে নিয়োগ করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা হত্যার কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ঈসার (আ.) আকৃতি দান করে প্রকৃত ঈসাকে আকাশে তুলে নিলেন আর কাফিররা তাকে ‘ঈসা’ ভেবে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই তাদের ষড়যন্ত্রের জবাবে কৌশল অবলম্ভন করেছিলেন। আর আল্লাহ তায়ালাই কারো ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য উত্তম কৌশলী।
সেদিন যারা ঈসাকে (আ.) হত্যার জন্য উম্মাদ হয়ে উঠেছিল, তাদের ও ঈসার (আ.) মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার হাক্বীকাত বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা তার হাবীব মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে তা পেশ করেন। হাত্যাকারীদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি তাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে সুরক্ষা দিয়ে দুনিয়ায় তার বয়সকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তাকে আকাশে তুলে নিবেন এবং ঈমানদারদেরকে (যারা তাকে অনুসরণ করবে এবং মোহাম্মদ সম্পর্কে তিনি যে সুসংবাদ দিয়েছেন তা মেনে নিয়ে তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে) কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপর বিজয়ী দান করবেন। অতঃপর তাদের সবাইকে হাশরের ময়দানে একত্র করে ‘ঈসা’ এর সাথে কেমন আচরণ করেছিলো তার বিচার করা হবে।
সুতরাং ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা তাকে অস্বীকার করবে এবং খৃষ্টানদের মধ্য থেকে যারা তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে তাদেরকে দুনিয়ায় হত্যা করে, সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে ও ক্ষমতাচ্যুত করে শাস্তি দেওয়া হবে এবং আখেরাতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ আযাব থেকে রক্ষা করার মতো কোন সাহায্যকারী থাকবে না।
অপরদিকে যারা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং সৎআমল করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দান করবেন। আর যারা শিরক ও কুফরের মাধ্যমে নিজেদের উপর যুলম করে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পছন্দ করেন না। আর যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, মারইয়াম এবং ঈসা (আ.) এর কাহিনী, যা আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে পাঠ করে শুনাচ্ছেন, তা হলো আয়াত এবং হিকমাতপূর্ণ উপদেশ। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৬৮, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩২২-৩২৩, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৬-৫৭, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৩-৯৪) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿أَحَسَّ﴾ “সে অনুভব করেছে”, আয়াতাংশের অর্থ হলো: ‘সে জানতে পেরেছে’ অথবা ‘সে পেয়েছে’। কারণ, যখন কেউ কিছু জানতে পারে অথবা কিছু পেয়ে থাকে. তখন আরবরা বলে থাকেন: ‘হাল আহসাসতা’ বা তুমি কি অনুভব করেছো?। (মায়ানী আল-কোরআন, যুজাজ: ১/৪১৬) ।
﴿الْكُفْرَ﴾ “কুফরি”, আয়াতাংশ দ্বারা ঈসা (আ.) এর প্রতি ইহুদীদের অস্বীকৃতি, ইনজীলের বিধানের সাথে বিরুদ্ধাচরণ এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকে একত্রে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৫২) ।
﴿إِلَى اللَّهِ﴾ “আল্লাহর দিকে”, আয়াতাংশের অর্থ হলো:
(ক) ‘আল্লাহর সাথে’, ‘ইলা’ বা দিকে যখন ‘গাইয়াহ’ বা প্রান্ত অর্থে না আসে, তখন আরবরা তা ‘মা’য়া’ বা সাথে অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। (মায়ানী আল-কোরআন, ফাররা: ১/২১৮)। তখন আয়াতের অর্থ হবে: আল্লাহর সাথে আমার সাহায্যকারী কে আছো?
(খ) ‘আল্লাহর পথের দিকে’, এখানে আল্লাহ শব্দের পূর্বে ‘সাবীল’ বা পথ সম্বন্ধ পদটি উহ্য রয়েছে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৯৭, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩৭) । তখন আয়াতের অর্থ হবে: আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী আছো?
﴿الْحَوَارِيُّونَ﴾ ‘আল-হাওয়ারিয়্যূন’, আয়াতাংশে ‘হাওয়ারিয়্যূন’ শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো সাধা। এর দ্বারা ঈসা (আ.) এর ১২ জন সহচরকে বুঝানো হয়েছে। তাদেরকে ‘হাওয়ারিয়্যূন’ বলার কারণ কি? এ বিষয়ে তাফসীরকারকগণ বলেন:
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: তারা সাধা পোষাক পড়তেন, এজন্য তাদেরকে ‘হাওয়ারিয়্যূন’ বলা হতো। আর তারা পেশায় শিকারী ছিলেন।
(খ) মারইয়াম (আ.) তার ছেলে ঈসাকে (আ.) অনেক কাজ শিক্ষা দিয়েছেন। অবশেষে তিনি তাকে কাপড় রঙ করানোর কাজ শিখানোর জন্য হাওয়ারী রঞ্জকদের কাছে পাঠালেন। ঈসার (আ.) শিক্ষক সফর করতে চেয়েছিলেন। অতঃপর তিনি তাকে বললেন: আমার কাছে বিভিন্ন রঙের কাপড় রয়েছে, আমি যে তোমাকে রঙ করা শিখিয়েছি, তদানুযায়ী এ পোষাকগুলো রঙ করে দাও। ঈসা (আ.) একটি দানা রান্না করে তাতে সব পোষাক ঢেলে দিয়ে বললেন: আমি যেভাবে রং করতে চাই আল্লাহর ইচ্ছায় সেভাবে হয়ে যাও। অতঃপর হাওয়ারী শিক্ষক এসে তার এ অবস্থা দেখে বললেন: তুমি তো সব কাপড় নষ্ট করে ফেলেছো। জবাবে ঈসা (আ.) সব কাপড়গুলো লাল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি রঙে বের করে আনলেন। এতে শিক্ষক আশ্চর্য হয়ে জানতে পারলেন এটা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে এবং তিনি তাঁর দিকেই মানুষকে আহবান করেন। অতঃপর তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরাই হলেন ‘হাওয়ারিয়্যূন’। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৯৮) ।
(গ) ঈসা (আ.) গমণ পথে একদল জেলেকে মাছ শীকার করতে দেখে বললেন: আসো আমরা মানুষ শীকার করি। তিনি নিজেকে তাদের কাছে আল্লাহর রাসূল হিসেবে পরিচয় দিলে তারা মুজিযা দেখতে চায়। অতঃপর তিনি মুজিযা দেখালে তাদের সকলে ঈমান গ্রহণ করেন। তাদেরকে ‘হাওয়ায়ি্যূন’ বলা হয়। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৮/২৩৪) ।
﴿الشَّاهِدِينَ﴾ “সাক্ষীগণ”, আয়াতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: উম্মতে মোহাম্মাদী, যারা তাদের নবীর দাওয়াতী কাজের পূর্ণতা এবং কাফেরদের অস্বীকৃতির ব্যাপারে কিয়ামতের দিন সাক্ষী হবেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭) । সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: ঐ সকল সাক্ষীদের সাথে আমাদেরকেও ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করুন।
﴿إِنِّي مُتَوَفِّيكَ﴾ “নিশ্চয় আমি তোমার নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ করব”, আয়াতাংশে নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের অভিমত নিম্নে:
(ক) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) জাগ্রতাবস্থায় আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং শেষ যমানায় তাকে পুনরায় মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পৃথিবী সংস্কারের উদ্দেশ্যে পাঠাবেন।
(খ) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) ঘুম পড়িয়ে আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং শেষ যমানায় মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পৃথিবী সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করবেন।
(গ) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) মৃত্যুর মাধ্যমে আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং শেষ যমানায় তাকে পুনরায় জীবিত করে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পৃথিবী সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করবেন।
তবে দ্বিতীয় মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য; কারণ পৃথিবী থেকে আকাশের এ বিশাল দুরত্ব পাড়ি দেওয়া একজন জাগ্রত মানুষের জন্য যেমন ভয়াবহ, তেমনিভাবে পথে এমন কিছু ভয়াবহ বিষয় রয়েছে, যা অবলোকন করা তার দৃষ্টি শক্তির ক্ষমতার বাহিরে।
প্রথম মতটি দ্বিতীয় মতের নিকটবর্তী। আর তৃতীয় মতটি দুই কারণে দূর্বল:
(ক) সূরা নিসা এর ১৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে: ঈসার (আ.) মৃত্যুর পূর্বে সকল আহলে কিতাব তার প্রতি ঈমান গ্রহণ করবে। এ আয়াত থেকে বুঝা যায় তিনি মৃত্যুবরণ করেননি।
(খ) আল্লাহ তায়ালার সুন্নাত বা সাধারণ নিয়ম হলো তিনি কাউকে মৃত্যুর পরে জীবিত করেন না, ঈসা (আ.) এর ক্ষেত্রেও তার বিপরীত নয়। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৫৫) ।
﴿رَافِعُكَ إِلَيَّ﴾ “তোমাকে আমার দিকে উত্তোলনকারী”, সকল তাফসীরকারক একমত যে আয়াতাংশে ‘আমার দিকে’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আকাশে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/১৯) ।
﴿مُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا﴾ ‘তোমাকে কাফেরদের থেকে পবিত্রকারী’, আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) কি থেকে পবিত্র করবেন? এ ব্যাপারে অধিকাংশ তাফসীরকারকদের অভিমত হলো: তার মায়ের ব্যাপারে কাফেরদের মিথ্যা অপবাদ থেকে তাকে পবিত্র করবেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩৮) ।
﴿فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا﴾ ‘কাফেরদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব’, আয়াতাংশে দুই দিকের শ্রেষ্ঠত্বকে বুঝানো হয়েছে:
(ক) ঈসার (আ.) অনুসারীগণ মোহাম্মদ (সা.) এর আগমণের পর তার উপর ঈমান গ্রহণ করে তাকে অনুসরণ করলে আল্লাহ তায়াল কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে ঈমান, আক্বীদা ও শরীয়াহ এ শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় রাখবেন। (আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৭) ।
(খ) আল্লাহ তায়ালা বিজয় প্রদানের মাধ্যমে খৃষ্টানদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত ইহুদীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিবেন। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/১৯) ।
﴿فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ﴾ ‘যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করেছিলে’, আয়াতাংশে তাদের মতবিরোধের বিষয়বস্তু কি ছিল? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের অভিমত নিম্নে:
(ক) ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হওয়ার বিষয়ে তাদের মতবিরোধের ফয়সালা করবেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭) ।
(খ) ঈসাই ধর্মের বিষয়ে তাদের মতবিরোধের ফয়সালা করবেন। (তাফসীর আল-নাসাফী: ২/১৯) ।
পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসা (আ.) এর দশটি বৈশিষ্ট্য এবং চারটি মুযিজা উল্লেখ করার মাধ্যমে তার নবুয়াতকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে দাওয়াতী ময়দানে ঈসা (আ.) এর সাথে তার কওমের ঘটে যাওয়া কাহিনী, তাকে হত্যার পরিকল্পনা, আকাশে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তাকে মুক্তি প্রদান, যারা তাকে অস্বীকার করেছে তাদের পরিণতি এবং যারা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে তাদের পুরস্কারের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩৮-২৩৯) ।

৫৮ নং আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
হাসান বাসারী (র.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে নাজরান থেকে দুইজন খৃষ্টান পাদ্রী এসে প্রশ্ন করেছিলেন ঈসার (আ.) আব্বার নাম কি? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর প্রদানে তাড়াহুড়া না করে তার রবের পক্ষ থেকে অহীর অপেক্ষা করলে আল্লাহ তায়ালা আটান্ন নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন যে পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসার (আ.) আত্মীয়-স্বজনের কাহিনী, তার মায়ের জন্মের ঘটনা এবং তার নিজের জন্মের ঘটনাই তাদের অযৌক্তিক প্রশ্নের জবাব। (আসবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৬২) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। বায়ান্ন নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) আল্লাহর দ্বীনকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন, তারা অবশ্যই অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-যুলম, হত্যা-রক্তাপাতের সম্মুখীন হবেন।
(খ) দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করতে আল্লাহর পথের দায়ীদের এমন কিছু একনিষ্ঠ সহচরের প্রয়োজন হয়, যারা বিপদ মুহুর্তে ঢালের মতো তাদের পাশে থাকবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৪৩) । যেমন: অত্র আয়াতে ঈসাকে (আ.) দেখতে পাই তিনি তার কওম থেকে একনিষ্ঠ কিছু সহচর অনুসন্ধান করেছিলেন। অনুরুপভাবে রাসূলুল্লাহর (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের মধ্য থেকে কিছু একনিষ্ঠ সহচর ছিল। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (সা.) আহযাব যুদ্ধের দিন বলেছেন:
مَنْ يَأْتِينَا بِخَبَرِ الْقَوْمِ؟ فَقَالَ الزُّبَيْرُ: أَنَا، ثُمَّ قَالَ: مَنْ يَأْتِينَا بِخَبَرِ الْقَوْمِ؟ فَقَالَ الزُّبَيْرُ: أَنَا، ثُمَّ قَالَ: مَنْ يَأْتِينَا بِخَبَرِ الْقَوْمِ، فَقَالَ الزُّبَيْرُ: أَنَا، ثُمَّ قَالَ إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِيَّ وَإِنَّ حَوَارِيَّ الزُّبَيْرُ. (متفق عليه، صحيح البخاري: ৪১১৩).
অর্থাৎ: কুরাইশ কাফিরদের খবর আমাদের নিকট কে এনে দিতে পারবে? যুবায়ের (রা.) বললেন: আমি। তিনি আবার বললেন: কুরাইশদের খবর আমাদের নিকট কে এনে দিতে পারবে? তখনও যুবায়ের (রা.) বললেন: আমি। তিনি আবারও বললেন: কুরাইশ কাফিরদের খবর আমাদের নিকট কে এনে দিতে পারবে? এবারও যুবায়ের (রা.) বললেন: আমি। অতঃপর তিনি বললেন: নিশ্চয় প্রত্যেক নবীরই হাওয়ারী বা বিশেষ সাহায্যকারী ছিল। আমার হাওয়ারী হলো: যুবায়ের। (মুত্তাফাকুন আলাইহি, সহীহ আল-বুখারী: ৪১১৩) ।
(গ) যারা আল্লাহর পথের দায়ীদের একনিষ্ঠ সহচর হবে, তারা চাইলে দায়ীদেরকে পরিতুষ্ট করা ও সাক্ষী রাখার উদ্দেশ্যে তাদের ঈমান ও ইসলামের আত্মস্বীকৃতি প্রদান করতে পারবে। যেমন: উল্লেখিত আয়াতের শেষাংশে হাওয়ারীগণ ঈসার (আ.) ডাকে সারা দেওয়ার পর বলেছিলেন: আপনি সাক্ষী থাকেন “নিশ্চয় আমরা মুসলিম”।
২। ৫৩নং আয়াতে সাক্ষীগণ দ্বারা নিম্নের যে কোন একটি অথবা সবগুলো উদ্দেশ্য হতে পারে:
(ক) অধিকাংশ আলেম মনে করেন, মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) এর উম্মতকে বুঝানো হয়েছে।
(খ) যারা নবী-রাসূলদেরকে সত্যবাদী হিসেবে সাক্ষী দিয়েছেন, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৯৮) ।
(গ) যারা আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদের সাক্ষী দিয়েছেন, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৫৮) ।
৩। ৫৪নং আয়াতে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ঈসা (আ.) তার কওমের কাছে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে গেলে তাকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল, আর আল্লাহ তায়ালা তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
(খ) এখানে বলা হয়েছে: “আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্র করেছেন এবং তিনিই উত্তম ষড়যন্ত্রকারী”। আর ‘ষড়যন্ত্র করা’ ক্রিয়াটি খারাপ অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। তাহলে আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্র করেছেন এর অর্থ কি হতে পারে? এটি একটি আক্বীদা বিষয়ক মাসয়ালা, এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি অভিমত পাওয়া যায়:
(ক) একদল তাফসীরকারক মনে করেন, “ষড়যন্ত্র করা” আল্লাহ তায়ালার একটি সিফাত বা গুণ, যা কেবলমাত্র কারো ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় প্রয়োগ হয়ে থাকে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/১৯, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭) । এ মতের অনুসারীগণ মনে করেন আল্লাহর কোন সিফাতকে কোন ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিলুপ্তিকরণ, বিকৃতিকরণ এবং সাদৃশ্যকরণ ছাড়া দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করা। এটিই প্রকৃত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস। (শারহ আল-আক্বীদাহ আল-ওয়াসিতিয়্যাহ, খলীল হাররাস: ৬৫) ।
(খ) আরেকদল তাফসীরকারক মনে করেন, “ষড়যন্ত্র করা” শব্দটি আল্লাহর শানে বেমানান হওয়ার কারণে তা এমন একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার হবে, যা আল্লাহর শানে মানানশীল, যেমন: আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রের জন্য শাস্তি দিয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন ইত্যাদি। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৫৮, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৩) । এ মতের অনুসারীদেরকে আহলুত তা’ভীল বলা হয়। তারা মনে করেন আল্লাহ তায়ালার সিফাত বা গুণাবলীকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাবে। আশায়েরাহ এবং মাতুরিদিয়্যাহ সম্প্রদায় এ মতকে গ্রহণ করেছেন। (মাওসূআতুল ফিরাক্ব, দুরার আস-সুন্নিয়্যাহ) ।
তবে প্রথম মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য, কারণ সালফে সালিহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, তারিয়ূন এবং তাবে তাবিয়ীনগনের কাছে আল্লাহর সিফাতগুলো যেভাবে বলা হতো তাতে কোন ধরণের জিজ্ঞাসা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া সে ভাবেই তারা বিশ্বাস করতেন। (শারহ আল-আক্বীদাহ আল-ওয়াসিতিয়্যাহ, খলীল হাররাস: ৬১) ।
৪। ৫৫নং আয়াতে ঈসার (আ.) প্রতি আল্লাহ তায়ালার পাঁচটি অনুগ্রহ বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) যখন কাফেররা ঈসাকে (আ.) হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল, তখন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় তার বয়সের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তাদের সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
(খ) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) আকাশে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে কাফেরের ষড়যন্ত্র থেকে তাকে সংরক্ষণ করেছেন।
(গ) তার মায়ের ব্যাপারে কাফেরদের মিথ্যা অপবাদ থেকে তাকে পবিত্র করেছেন।
(ঘ) যারা ঈসাকে (আ.) অনুসরণ করবে এবং মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমেণের পর তার প্রতি ঈমান এনে তাকেও অনুসরণ করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত ঈমান, আক্বীদা ও শরীয়াহ এ শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় রাখবেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭)।
(ঙ) হাশরের ময়দানে সবাইকে জড়ো করে ঈসার (আ.) ব্যাপারে যে মতবিরোধ করেছিল, তার বিচার করা হবে।
৫। ৫৬নং আয়াত থেকে বুঝা যায় ঈসার (আ.) প্রতি আল্লাহ তায়ালার পাঁচটি অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে, তাদের শাস্তির ভয়াবহতা হবে নিম্নরুপ:
(ক) দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে।
(খ) শাস্তির যন্ত্রণা প্রচন্ড আকারের হবে।
(গ) শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে কোন সাহায্যকারী পাবে না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৪০-২৪১) ।
৬। ৫৭নং আয়াত থেকে বুঝা ঈসার (আ.) প্রতি আল্লাহ তায়ালার পাঁচটি অনুগ্রহকে স্বীকার করে সৎআমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পুরুস্কৃত করবেন। এ আয়াত থেকে নিম্নের কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ঈমান ও সৎআমল দুইটি আলাদা জিনিস; কারণ এখানে সংযোজন পদ দিয়ে দুইটি ভিন্ন জিনিসকে একত্র করা হয়েছে।
(খ) আখেরাতে মানুষ পুরস্কৃত হবে তার ঈমান ও সৎআমলের কারণে।
(গ) যালেমদের জন্য আল্লাহ তায়ালা কল্যাণসাধন করেন না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৪১-২৪২) ।
৭। ৫৮নং আয়াত থেকে বুঝা যায় যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, মারইয়াম এবং ঈসা (আ.) এর ঘটনা বর্ণনা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি আল্লাহ তায়ালার অহীর সত্যতার প্রমাণ বহণ করে; কারণ অহী ছাড়া এ সকল ঘটনা জানা রাসূলুল্লাহর (সা.) জন্য সম্ভব ছিল না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৪২) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর পথের দায়ী দাওয়াতী কাজের সহযোগিতার জন্য একান্ত সহচর নির্বাচন করবে।
(খ) একজন অনুসারী তার মুসলিম হওয়ার বিষয়ে তার দ্বীনী অভিভাবকের কাছে স্বীকৃতি দিবে।
(গ) ঈসাকে (আ.) আল্লাহ তায়ালা জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মাত হয়ে আগমণ করে সমাজ সংশোধন করবেন, এ কথা বিশ্বাস করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৪৫-৫১) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: ঈসা (আ.) এর জীবনী প্রসঙ্গ তার আগমণের সুসংবাদ এবং আল্লাহ প্রদত্ত দশটি বৈশিষ্ট্য।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿إِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ (45) وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ (46) قَالَتْ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ قَالَ كَذَلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (47) وَيُعَلِّمُهُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ (48) وَرَسُولًا إِلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ أَنِّي أَخْلُقُ لَكُمْ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنْفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللَّهِ وَأُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ وَأُحْيِ الْمَوْتَى بِإِذْنِ اللَّهِ وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (49) وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُمْ بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ وَجِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ (50) إِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ (51)﴾ [سورة آل عمران: 45-51].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:
ঈসা (আ.) এর জীবনী প্রসঙ্গ তার আগমণের সুসংবাদ এবং আল্লাহ প্রদত্ত দশটি বৈশিষ্ট্য।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৪৫। (স্বরণ করো) যখন ফেরেশতা বললো: হে মরইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হবে মাসীহ ঈসা ইবনু মারইয়াম, যিনি দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবেন।
৪৬। এবং সে কথা বলবে মানুষের সাথে দোলনায় ও পরিণত বয়েসে, আর সে নেক্কারদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
৪৭। মারইয়াম (আ.) বললো: হে আমার রব! কিভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ আমাকে স্পর্শ করেনি কোন মানুষ। তিনি বললেন: এ ভাবে আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়ের, তখন তিনি শুধু তাকে বলেন: হও, ফলে তা হয়ে যায়।
৪৬। এবং তিনি তাকে কিতাব, হিকমাত, তাওরাত এবং ইনজীল শিক্ষা দিবেন ।
৪৯। সে বনী ইসরাঈলের একজন রাসূল হবে; (সে বলবে) নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট এসেছি তোমাদের রবের আয়াত নিয়ে, নিশ্চয় আমি বানাবো তোমাদের জন্য মাটি থেকে পাখির আকৃতি, অতঃপর তাতে ফুঁক দিবো, ফলে তা আল্লাহর হুকুমে একটি পাখি হয়ে যাবে; আমি সুস্থ করবো জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রুগীকে এবং মৃতকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করবো; আর তোমাদেরকে জানিয়ে দিবো যা তোমরা আহার করো এবং যা তোমাদের ঘরসমূহে জমা করে রাখো; নিশ্চয় এতে রয়েছে নিদর্শন তোমাদের জন্য, যদি তোমরা হয়ে থাকো মুমিন।
৫০। এবং (সে বলবে: আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে) সত্যায়নকারীরুপে যা রয়েছে আমার সামনে তাওরাত থেকে; এবং হালাল করতে তোমাদের জন্য কিছু অংশকে যা তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছিল; এবং তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে আয়াত নিয়ে এসেছি; সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাকে অনুসরণ করো।
৫১। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমার রব এবং তোমাদের রব, অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত করো; এটাই সরল পথ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন: যখন জিবরীল (আ.) মারইয়াম (আ.) কে অলৌকিকভাবে পিতা বিহীন মাসীহ ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ.) এর সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের কাছে ছিলেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে দশটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন:
(ক) দুনিয়াতে অহী প্রদান এবং আখেরাতে জান্নাত প্রদানের মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হবে।
(খ) আখেরাতে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(গ) দোলনায় থাকাবস্থায় তার মায়ের পবিত্রতা ঘোষণার জন্য শিশুকালে মানুষের সাথে কথা বলবেন ও বৃদ্ধাবস্থায় তাদেরকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিবেন।
(ঘ) কথায় ও কাজে নেক্কার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(ঙ) তিনি পিতা বিহীন মারইয়ামের গর্ভে অলৌকিভাবে সৃষ্টি হয়েছেন, এ অলৌকিক সুসংবাদে আশ্চর্যান্বিত হয়ে মারইয়াম (আ.) বললেন: আমার কিভাবে সন্তান হবে! অথচ আমার স্বামী নেই এবং কোন বেগানা পুরুষ আমাকে কোন দিন স্পর্শ করেনি। অথচ সন্তান হওয়ার জন্য একজন পুরুষের সংস্পর্শে যেতে হয়। তখন জিবরীল (আ.) উত্তর দিলেন: পিতা বিহীন সন্তান দান করা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মোটেই কঠিন বিষয় নয়, এভাবেই তিনি কোন বিষয় করার সিদ্ধান্ত নিলে, শুধু বলেন হও, ফলে সাথে সাথেই তা হয়ে যায়।
(চ) ঈসাকে (আ.) হস্তলিপি, প্রজ্ঞা, তাওরাত এবং ইনজীল শিক্ষা দিয়েছেন।
(ছ) তিনি বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসূল।
(জ) রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে চারটি মুজেযা দান করেছেন, যেমন: মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুঁক দিলে জীবন্ত পাখি হওয়া, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা, আল্লাহর হকুমে মৃতকে জীবিত করা এবং কারো ঘরে যা খাওয়া হয়েছে ও যা জমা রাখা হয়েছে তা সম্পর্কে সংবাদ দিতে পারা।
(ঝ) তিনি তাওরাতের সত্যায়নকারী।
(ঞ) বনী ইসরাঈলের উপর যা হারাম করা হয়েছিল তার মধ্য থেকে কিছু অংশ হালাল করা। অতঃপর ঈসা (আ.) তার বংশধরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: যেই আল্লাহ আমাকে দশটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে তোমাদের কাছে পাঠালেন তোমরা তাকে ভয় করো এবং আমার অনুসরণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমার এবং তোমাদের মা’বূদ ও পালনকর্তা, অতএব একমাত্র তারই ইবাদত করো। এটাই সরলসহজ পথ। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৫৭, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১৮-৩২০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৫-৫৬, আল-মোন্তাখাব: ১/৯২-৯৩) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْمَلَائِكَةُ﴾ “ফেরেশতাগণ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: জিবরীল (আ.) । জিবরীল (আ.) এর সম্মানের বিবেচনায় শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে; কারণ তিনি ফেরেশতাদের সরদার ছিলেন। এছাড়াও সূরা মারইয়াম এর ১৭ নাম্বার আয়াতে জিবরীল (আ.) এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/৫৪) ।
﴿بِكَلِمَةٍ مِنْهُ﴾ “তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালেমার”, আয়াতাংশে ‘কালেমা’ আরবী শব্দ, যার অর্থ হলো: শব্দ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘কুন’ বা হও, যার দ্বারা ঈসাকে (আ.) বুঝানো হয়েছে; কারণ তাকে আল্লাহ তায়ালা পিতা বিহীন অলৌকিক ক্ষমতাবলে ‘কুন’ কালেমা দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৪৫) ।
﴿الْمَسِيحُ﴾ “আল-মাসীহ”, শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো: স্পর্শকারী। আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) এ নামে ভ‚ষিত করেছেন। তবে এ নামে ভ‚ষিত করার কারণ কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) তিনি কোন রোগীকে স্পর্শ করলে সে আরোগ্য লাভ করবে।
(খ) তিনি বেশী বেশী ভ্রমণ করার কারণে যমীনের বেশীর ভাগ অংশের সংস্পর্শ পেয়েছেন।
(গ) ‘আল-মাসীহ’ এর আরেকটি অর্থ হলো: সুন্দর। ঈসা (আ.) দেখতে সুন্দর ছিলেন, তাই তাকে ‘আল-মাসীহ’ বলা হয়েছে।
কাওয়ারী (র.) বলেন: প্রথম মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৪৫) ।
﴿فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا﴾ “দোলনায় এবং বার্ধক্য অবস্থায়”, সকল তাফসীরকারক একমত যে আয়াতাংশে ‘আল-মাহদ’ বা দোলনা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: নবজাতকের প্রথম দুই বছর, যে সময়ে মায়ের বুকের দুধ পান করে থাকে।
আর ‘কাহল’ শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো: যৌবন এবং শক্তির সমন্বয় ঘটা। যখন উদ্ভিদ প্রবল শক্তি দিয়ে গজিয়ে উঠে তখন আরবরা তাকে ‘কাহল’ বলে থাকেন। আয়াতাংশে ‘কাহল’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) মানুষের ৩০ বছর থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত বয়স সীমাকে ‘কাহল’ বলে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৫৩) ।
(খ) মানুষের ৪০ বছর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে ‘কাহল’ বলে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২৯) ।
(গ) মানুষের যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যবর্তী সময়কে ‘কাহল’ বলে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩১৮) ।
(ঘ) হুসাইন ইবনু ফাযল (র.) বলেন: শেষ যমানায় আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়ে ঈসা (আ.) মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ‘কাহল’ দ্বারা এ সময়কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৪২০, আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২২৫) ।
তবে তৃতীয় মতটি সঠিক হওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী; কারণ ঈসাকে (আ.) ৩৩ বছর বয়েসে আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছে। এ হিসেবে তিনি আকাশে উঠে যাওয়ার পূর্বে ‘কাহল’ এর বয়স সীমায় উপনীত হননি। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২২৫) ।
﴿الْكِتَابَ﴾ ‘কিতাব’, দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: হস্তলিপি। আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) কে হস্তলিপি শিক্ষা দিয়েছিলেন। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৪২২) ।
﴿الْحِكْمَةَ﴾ ‘হিকমাহ’, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইনজীলের বাহিরে ঈসা (আ.) এর বাণী, যা পান্ডুলিপি আকারে লেখা হয়েছে। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৪২২) ।
﴿وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ﴾ ‘যা তোমরা খেয়ে ফেলো এবং যা তোমাদের ঘরে জমা করে রাখো, সে বিষয়ে আমি সংবাদ দিবো’, আয়াতাংশ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) এর বংশধরদের উপর আসমানি খাবার অতবীর্ণ করতেন, যা ঘরে না জমিয়ে খেয়ে ফেলার নির্দেশ ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার পরে ঘরে জমা করে রাখার চেষ্ট করছিল। এ বিষয়টি তদারকি করার জন্য আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) কে গায়েব জানার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ফলে, তিনি একজনে কি পরিমাণ খাবার খেয়েছে তা জানার পাশাপাশি কেউ খাবার জমা করে রাখলে তাও তিনি বুঝতে পারতেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২২৯) ।
﴿وَلِأُحِلَّ لَكُمْ بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ﴾ ‘কিছু বিষয়, যা হারাম করা হয়েছিল’, আয়াতাংশে হারাম হওয়া বিষয় দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র.) থেকে দুইটি উত্তর পাওয়া যায়:
(ক) মূসা (আ.) এর মৃত্যুর পর ইহুদী আহবার বা পন্ডিতগণ তাদের ধর্মের সাথে নিজেদের মনগড়া বানোয়াট বিষয় সংযোগ করে মূসা (আ.) এর দিকে নিসবাত করেছিল। ঈসা (আ.) এসে বানোয়াট বিষয়গুলোকে ধর্ম থেকে দুর করেছিলেন। সুতরাং আয়াতাংশে ইহুদী ধর্মে তাদের পন্ডিতদের বানোয়াট বিষয়গুলোকে বুঝানো হয়েছে।
(খ) ইহুদীদের হটকারিতা এবং অপকর্মের শাস্তি স্বরুপ কিছু হালাল বিষয়কে আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর হারাম করেছিলেন। ঈসা (আ.) এসে উক্ত হারাম বিষয়সমূহকে পুনরায় হালাল করেছিলেন। সুতরাং আয়াতাংশে শাস্তি স্বরুপ ইহুদীদের উপর হারাম হওয়া বিষয়গুলোকে বুঝানো হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৩১) ।
﴿وَجِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ﴾ ‘এবং আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে কিছু আয়াত নিয়ে এসেছি’, আয়াতাংশে ‘কিছু আয়াত’ দ্বারা ঈসা (আ.) এর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ব পাঁচটি মুজিযাকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৪৪০) ।

পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসা (আ.) এর নিকটাত্মীয় যাকারিয়্যা (আ.), ইয়াহইয়া (আ.) এবং ঈসা (আ.) এর মা মারইয়াম (আ.) এর ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে ঈসা (আ.) এর জন্মের কাহিনী বর্ণনা করার মাধ্যমে তার জন্মের প্রকৃত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পঁয়তাল্লিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহর কাছে মারয়াম (আ.) এর মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু ফেরেশতা জিবরীল (আ.) মানুষের আকৃতিতে তার কাছে এসে ঈসা (আ.) এর সুসংবাদ দিয়েছেন (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩১৮) । এ সম্পর্কে সূরা মারয়াম এ বলা হয়েছে:
﴿فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا﴾ [سورة مريم: ১৭).
অর্থাৎ: “আমি তার কাছে জিবরীলকে পাঠালাম, সে পুরোপুরি একজন মানুষের আকৃতিতে তার সামনে আত্মপ্রকাশ করলো” (সূরা মারইয়াম: ১৭) ।
২। সাতচল্লিশ নাম্বার আয়াত থেকে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) অস্পষ্ট কোন বিষয়ের হাক্বীকত বা হেকমাত বুঝার জন্যে ব্যাখ্যা তলব করা জায়েজ আছে। কারণ অত্র আয়াতে দেখতে পাই মারইয়াম (আ.) যখন পুরুষ মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া সন্তান হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারলেন না, তখন তিনি ব্যাখ্যা চেয়েছেন। অনুরুপভাবে অত্র সূরার চল্লিশ নাম্বার আয়াতে যাকারিয়া (আ.) যখন বৃদ্ধ বয়েসে বন্ধা স্ত্রীর গর্ভে সন্তান হওয়ার সুসংবাদের বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন না, তখন তিনি আল্লাহর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩১৮) ।
(খ) ঈসা (আ.) এর আগমণের সুসংবাদকে ‘সৃষ্টি করা’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কারণ ঈসার (আ.) জন্ম গ্রহণ পিতাবিহীন সাধারণ নিয়মের বিপরীত বিস্ময়করভাবে সংগঠিত হয়েছিল। অপরদিকে চল্লিশ নাম্বার আয়াতে ইয়াহইয়ার (আ.) আগমণের সুসংবাদকে ‘করা’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কারণ ইয়াহইয়ার (আ.) জন্ম গ্রহণ স্বাভাবিক নিয়মে সংগঠিত হয়েছিল। (আল-বাহ্র আল-মুহীত, আবু হাইয়্যান: ৩/১৫৮) ।
(গ) আল্লাহ তায়ালা নিজ ইচ্ছায় কোন কিছু করতে চাইলে যা চান তা তৎক্ষণাৎ করে ফেলেন। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৪২১) । এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
৩। পঁয়তল্লিশ থেকে পঞ্চাশ নাম্বার আয়াতে ঈসার (আ.) দশটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) দুনিয়াতে অহী প্রদান এবং আখেরাতে জান্নাত দানের মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হবে।
(খ) আখেরাতে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(গ) দোলনায় থাকাবস্থায় তার মায়ের পবিত্রতা ঘোষণার জন্য শিশুকালে মানুষের সাথে কথা বলেছেন ও বৃদ্ধাবস্থায় পুনরায় ফিরে এসে তাদেরকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিবেন।
(ঘ) কথায় ও কাজে নেক্কার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
(ঙ) তিনি পিতা বিহীন মারইয়ামের গর্ভে অলৌকিভাবে সৃষ্টি হয়েছেন।
(চ) তাকে হস্তলিপি, প্রজ্ঞা, তাওরাত এবং ইনজীল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
(ছ) তিনি বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসূল ছিলেন।
(জ) রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাকে চারটি মুজেযা প্রদান করা হয়েছে।
(ঝ) তিনি তাওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন।
(ঞ) বনী ইসরাঈলের উপর যা হারাম করা হয়েছিল তার মধ্য থেকে কিছু অংশ তিনি হালাল করেছেন।
৪। উনপঞ্চাশ নাম্বার আয়াতে ঈসার (আ.) প্রতি চারটি মুজেযা বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফ‚ঁক দিলে জীবন্ত পাখি হওয়া।
(খ) জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা।
(গ) আল্লাহর হকুমে মৃতকে জীবিত করা।
(ঘ) কারো ঘরে যা খাওয়া হয়েছে ও যা জমা রাখা হয়েছে তা সম্পর্কে সংবাদ দিতে পারা। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
৫। পঞ্চাশ নাম্বার আয়াতের শেষাংশ থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) বনী ইসরাঈল যুগ যুগ ধরে শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকায় তা থেকে বেড়িয়ে আসা তাদের জন্য মোটেই সহজ ছিলো না। এজন্য আল্লাহ তায়ালা মু’জেযার কথা পুনরাবৃত্তি করেছেন, যাতে তার কথাগুলো তাদের অন্তরে গেথে যায় এবং তাদের চরিত্রকে প্রভাবিত করে।
(খ) আল্লাহর ভয় তাঁর রাসূলের অনুসরণকে আবশ্যক করে। এজন্য ঈসা (আ.) তার বংশধরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তোমরা যদি আল্লাহকে সত্যিকারে ভয় করে থাকো, তাহলে আমি যা আদেশ দিচ্ছি, তা অনুসরণ করা তোমাদের উপর আবশ্যক। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৩১) ।
৬। একান্ন নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় যে,
(ক) ‘তাওহীদ রুবুবিয়্যাহ’ পরিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়া ‘তাওহীদ উলুহিয়্যাহ’ মেনে নেওয়াকে আবশ্যক করে। কাফির-মুশরিকরা ‘তাওহীদ রুবুবিয়্যাহ’ কে আংশিক মানার কারণে ‘তাওহীদ উলুহিয়্যাহ’ কে অস্বীকার করে থাকে।
(খ) একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করাই হলো ‘সিরাতুল মুসতাকীম’। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৩১) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) দ্বীনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ের হাক্বীকত বা হেকমাত বুঝার জন্যে ব্যাখ্যা তলব করা।
(খ) আল্লাহকে ভয় এবং রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৪২-৪৪) আয়াতবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: মারইয়াম (আ.) এর কাহিনী।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿وَإِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ عَلَى نِسَاءِ الْعَالَمِينَ (42) يَا مَرْيَمُ اقْنُتِي لِرَبِّكِ وَاسْجُدِي وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ (43) ذَلِكَ مِنْ أَنْبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُونَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ (44) ﴾ [سورة آل عمران: 42-44].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: মারইয়াম (আ.) এর কাহিনী।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৪২। আর স্মরণ করো যখন ফেরেশতারা বললো: হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাকে মনোনীত করেছেন, তোমাকে পবিত্র করেছেন এবং তোমাকে নির্বাচিত করেছেন বিশ্বের নারীদের উপর।
৪৩। হে মারইয়াম! তোমার রবের জন্য অনুগত হও, সাজদা করো এবং রুক‚ করো রুক‚কারীদের সাথে।
৪৪। ঐটা গায়েবের সংবাদ, যা আমি অহী করছি তোমার প্রতি; তাদের মধ্যে কে দায়িত্ব নিবে মারইয়ামের? তা নির্ধারণের জন্য যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করেছিল, তখন তুমি তাদের কাছে ছিলে না; আর যখন তারা বিতর্ক করছিল, তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
নাজরান থেকে আগত খৃষ্টান, যারা ঈসা (আ.) কে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করতে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে তর্ক করেছিল, তাদেরকে ঈসা (আ.) এর মূল হাক্বীকাত স্মরণ করিয়ে দিতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে (সা.) নির্দেশ দিয়ে বলেন: তাদেরকে সে ঘটনা স্মরণ করিয়ে দাও, যখন একজন ফেরেশতা ঈসা (আ.) এর মা মারইয়ামকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আল্লাহ তায়ালা তাকে মাসজিদুল আক্বসার খেদমতের জন্য মনোনীত করেছেন, সকল ধরণের পাপ পঙ্কিলতা থেকে তাকে পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বজগতের সকল নারীর উপর ঈসা (আ.) এর মা হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছেন।
অতঃপর ফেরেশতা মারইয়াম (আ.) কে তিনটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন:
(ক) সে যেন আল্লাহর অনুগত হয়।
(খ) আল্লাহ তায়ালাকে যেন বিন¤্র সাজদা করে। এবং
(গ) সে যেন জামাতের সাথে সালাত আদায় করে।
ইমরান পরিবারের ঘটনা এবং যাকারিয়্যা (আ.), ইয়াহইয়া (আ.) ও মারইয়াম (আ.) এর ঘটনা, যা ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হলো, সবগুলোই অদৃশ্য জগতের ঘটনা, যা আল্লাহ তায়ালা অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহকে (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও মারইয়াম (আ.) এর তত্বাবধায়ক নির্ধারণ করতে যা ঘটেছিল সেখানেও রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত ছিলেন না। মারইয়াম (আ.) এর জন্মের পর তার তত্বাবধায়নের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনেকে ভিড় জমিয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনীত করার জন্য লটারীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আগ্রহী সকলে নদীতে কলম নিক্ষেপ করবে, যার কলম ভাষমান অবস্থায় স্থির থাকবে সেই হবে মারইয়াম (আ.) এর তত্বাবধায়ক। এতে দেখা গেল যাকারিয়্যা (আ.) এর কলমটি নদীতে স্থির থাকলো আর অন্য সকলের কলম ডুবে গেল। কথা অনুযায়ী যাকারিয়্যা (আ.) মারইয়ামের তত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ১৫১, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১৫-৩১৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৫, আল-মোন্তাখাব: ১/৯১-৯২) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْمَلَائِكَةُ﴾ “ফেরেশতাগণ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: জিবরীল (আ.) । (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/২১৭; তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২৩) ।
﴿اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ﴾ “তোমাকে মনোনীত করেছেন… এবং তোমাকে মনোনীত করেছেন”, আয়াতাংশে ‘তোমাকে মনোনীত করেছেন’ বাক্যাংশটি দুইবার এসেছে। প্রথম ‘মনোনীত করা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: মারইয়ামকে মাসজিদুল আক্বসার খেদমতের জন্য মনোনীত করেছেন। আর দ্বিতীয় ‘মনোনিত করা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: তাকে ঈসা (আ.) এর মা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২৩) ।
﴿وَطَهَّرَكِ﴾ “তোমাকে পবিত্র করেছেন”, আল্লাহ তায়ালা ‘মারইয়াম’ (আ.) কে কি থেকে পবিত্র করেছেন? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) তাকে কুফর এবং আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে পবিত্র রাখা হয়েছে।
(খ) তাকে খারাপ এবং কুরুচিপূর্ণ কাজ থেকে পবিত্র রাখা হয়েছে।
(গ) তাকে হায়েজ থেকে পবিত্র রাখা হয়েছে।
(ঘ) মানুষের সংস্পর্শ থেকে তাকে পবিত্র রাখা হয়েছে।
(ঙ) ইহুদীদের বেফাঁস কথাবার্তা থেকে আল্লাহ তাকে পবিত্র রেখেছেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/২১৮) । তবে উল্লেখিত সবগুলো বিষয় থেকে মারইয়াম (আ.) কে পবিত্র রাখা হয়েছে, আয়াত দ্বারা এ উদ্দেশ্য গ্রহণ করাতে কোন বাধা নেই; কারণ আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কোন একটিকে খাস করেননি, বরং সবগুলো মত গ্রহণ করার পথ উম্মুক্ত রেখেছেন। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
﴿وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ﴾ “এবং তুমি রুক‚কারীদের সাথে রুক‚ করো”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: মাসজিদুল আক্বসা এর প্রতিবেশীদের সাথে জামায়াতে সালাত আদায় করা। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২১৯) ।
﴿ذَلِكَ﴾ “ঐটা”, আয়াতাংশ দ্বারা পূর্বোল্লেখিত ইমরান পরিবার, যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া এবং মারইয়াম (আ.) এর ঘটনাকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী, ১/২৫৫) ।
﴿أَقْلَامَهُمْ﴾ “তাদের কলমসমূহ”, আয়াতাংশে কলমসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারক থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে, তাদের প্রত্যেকের তাওরাত লেখা অথবা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহ্যত কলমকে বুঝানো হয়েছে। যখন মারইয়াম (আ.) কে তত্বাবধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়ে গেল, তখন লটারীর মাধ্যমে তত্বাবধায়ক মনোনীত করার উদ্দেশ্যে তাদের প্রত্যেকের কলম নদীতে নিক্ষেপ করতে বলা হলো। যার কলম ভাষমান অবস্থায় স্থির থাকবে অথবা জোয়ারের উল্টা দিকে যাবে সে তত্বাবধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হবে। এতে যাকরিয়্যা (আ.) বিজয়ী হয়েছিলেন।
(খ) ইমাম রবী (র.) বলেন: তাদের প্রত্যেকের ব্যবহত হাতের লাঠিকে বুঝানো হয়েছে।
(গ) তৎকালীন আরবের প্রথানুযায়ী আগ্রহী সকলের নাম কাগজে লিখে এক জায়গায় রাখা হলো। যার নাম উঠবে সেই তত্বাবধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হবে। আর আরবী ভাষায় ‘কলম’ এর আরেকটি অর্থ হলো: ছাঁটাই করা। এর মাধ্যমে যেহেতু ছাঁটাই করা হয়েছে, সেহেতু একে ‘কলম’ বলা হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২১৯-২২০) ।

পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে যাকারিয়্যা (আ.) এর বৃদ্ধ বয়েসে তার বন্ধা স্ত্রীর ঔরসে ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) এর আগমণের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে, যা একটি অলৌকিক ঘটনা ছিল। মারইয়াম (আ.) এর গর্ভে পিতা বিহীন ‘ঈসা’ এর আগমণের সুসংবাদ আরেকটি অলৌকিক ঘটনা, যা উল্লেখিত আয়াতাবলীতে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং উভয় আয়াতের মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২৪) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। বিয়াল্লিশ নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা মারইয়াম (আ.) কে তিনটি বিষয় প্রদানের মাধ্যমে সকল নারীর উপর মনোনীত করে সম্মানিত করেছেন:
(ক) তাকে মাসজিদুল আক্বসার খেদমতের জন্য মনোনীত করেছেন।
(খ) তাকে কুফর, খারাপ কাজ, হায়েজ, সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ এবং ইহুদীদের বেফাঁস কথাবার্তা থেকে পবিত্র রেখেছেন।
(গ) তাকে ঈসা (আ.) এর মা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।
সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় আল্লাহ তায়ালা চার জন নারীকে বিশ্বের সকল নারীর উপর মর্যাদা দিয়েছেন। মারইয়াম বিনতু ইমরান, আসিয়া ফেরআউনের স্ত্রী, খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ এবং ফাতেমা বিনতু মোহাম্মদ।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: “خَيْرُ نِسَاءِ الْعَالَمِينَ مَرْيَمُ بِنْتُ عِمْرَانَ، وَآسِيَةُ بِنْتُ مُزَاحِمٍ، وَخَدِيجَةُ بِنْتُ خُوَيْلِدٍ، وَفَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ” (صحيح ابن حبان: ৬৯৫১).
অর্থাৎ: আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: বিশ্বজগতে শ্রেষ্ঠ নারীগণ হলেন: মারইয়াম বিনতু ইমরান, আসিয়া বিনতু মুযাহিম, খাদীজা বিনতু খুয়াইলেদ এবং ফাতিমা বিনতু মাহমূদ” (সহীহ ইবনু হিব্বান: ৬৯৫১) । শায়খ আলবানী (রহ.) অত্র হাদীসকে ‘সহীহ লিগাইরিহ’ বলেছেন।
২। তিতাল্লিশ নাম্বার হাদীস থেকে বুঝা যায় মারইয়াম (আ.) কে আল্লাহ তায়ালা সকল নারীর উপর মনোনীত করেছেন, তা ঠিক রাখার জন্য তাকে তিনটি বিষয় পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন: (ক) আল্লাহর আনুগত, (খ) সাজদা করা এবং (গ) জামায়াতে সালাত আদায় করা। এজন্য কারো জীবনে ভালো কিছু অর্জন হলে তার উপর উল্লেখিত তিনটি কাজ করা জরুরী। মারইয়াম (আ.) আল্লাহর অনুগত ছিলেন, এ ব্যাপারে সূরা তাহরীম এর ২২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
﴿وَصَدَّقَتْ بِكَلِماتِ رَبِّها وَكُتُبِهِ، وَكانَتْ مِنَ الْقانِتِينَ﴾ [التحريم: ১২].
অর্থাৎ: “এবং তিনি তার রবের কালেমা এবং তাঁর কিতাবকে সত্যায়ন করে, আর তিনি অনুগতদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন” (সূরা তাহরীম: ১২) ।
৩। চৌচল্লিশ নাম্বার আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইমরান পরিবার, যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, মারইয়াম এবং ঈসা (আ.) এর ঘটনা সহ সকল নবী-রাসূলের ইতিহাস অদৃশ্যের সংবাদ। এ আয়াত কোরআন আল্লাহর অহী হওয়ার সত্যতার প্রমাণ বহণ করে। এখানে যেমন ইমরান, যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, মারইয়াম এবং ঈসা এর ঘটনা বর্ণনার পর রাসূলুল্লাহকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলেছেন এগুলো অদৃশ্যের সংবাদ, অনুরুপভাবে কোরআনের অন্য জায়গাতে নূহ ও মূসা (আ.) এর ঘটনা বর্ণনার পর আল্লাহ তায়ালা একই কথা বলতে দেখা যায়। যেমন:
﴿تِلْكَ مِنْ أَنْباءِ الْغَيْبِ نُوحِيها إِلَيْكَ، ما كُنْتَ تَعْلَمُها أَنْتَ وَلا قَوْمُكَ مِنْ قَبْلِ هذا﴾ [سورة هود: ৪৯] অর্থাৎ: “হে নবী! ঐটা গায়েবের সংবাদ, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে অবহিত করিয়েছি, ইতিপূর্বে যা তুমি এবং তোমার কাওম জানতে না” (সূরা হূদ: ৪৯) ।
﴿وَما كُنْتَ بِجانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنا إِلى مُوسَى الْأَمْرَ﴾ [سورة القصص: ৪৪].
অর্থাৎ: হে নবী! মূসাকে যখন আমি নবুয়াত দিয়েছিলাম, তখন তুমি ত‚র পাহাড়ের পশ্চিম পাশে তুমি উপস্থিত ছিলে না” (সূরা ক্বাছাছ: ৪৪) ।
(খ) মারইয়াম (আ.) এর জন্মের পর তার লালন-পালনের জন্য তত্বাবধায়ন নির্ধারণের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। বিস্তারিত ঘটনা হলো: ইমরান (রা.) এর স্ত্রী ‘হান্না বিনতু ফাক‚জ’ তার গর্ভের সন্তানকে মাসজিদুল আক্বসার খেদমতের জন্য মানত করার পর সন্তানটি দুনিয়াতে আগমণ করলো তার নাম রাখা হলো মারইয়াম। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই তার লালন-পালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু একজনের তত্বাবধায়নের দায়িত্ব এতগুলো মানুষকে প্রদান করা সম্ভব না হওয়ার কারণে লটারীর মাধ্যমে যে কোন একজনকে তত্বাবধায়ক হিসেবে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সকলকে ব্যক্তিগত ব্যবহত কলম নিয়ে নদীর পারে আসার জন্য আহবান করা হলো। সকলে তাদের নিজ নিজ কলম নদীর ¯্রােতে নিক্ষেপ করবে, যার কলম ¯্রােতের উল্টা দিকে যাবে সেই হবে মারইয়ামের তত্ববধায়ক। ঘোষণা অনুযায়ী সকলে নদীতে তাদের কলম নিক্ষেপ করলো, সকলের কলম ¯্রােতে ভেসে গেল, কিন্তু মারইয়াম (আ.) এর খালা যাকারিয়া (আ.) এর কলমটি ¯্রােতের উল্টা দিকে যাচ্ছিল। অবশেষে যাকারিয়্যা (আ.) লটারীতে জিতে তার তত্বাবধায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৮৬) ।
(গ) জরুরী প্রয়োজনে ইসলামী শরীয়াতে ক্বোরয়া বা লটারী ব্যবস্থাকে বৈধ রাখা হয়েছে। কারণ, উল্লেখিত আয়াতে তত্বাবধায়ক নির্ধারণের জন্য লটারী করা হয়েছে। সূরা সাফ্ফাত এর ১৪১ নাম্বার আয়াতে দেখতে পাই ইউনুস (আ.) কে জাহাজ থেকে সমূদ্রে ফেলে দেওয়ার সময় পলায়নকারীকে বের করার জন্য ক্বোরয়া বা লটারী দেওয়া হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোথাও সফর করলে সফরসঙ্গী নির্ধারণের জন্য তার স্ত্রীদের মাঝে লটারী করতেন (সহীহ আল-বুখারী: ২৫৯৩)। একদল লোককে রাসূলুল্লাহ (সা.) হলফ করতে বললে সকলে তাড়াহুড়া করলে ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য তিনি লটারী করার নির্দেশ দিলেন (সহীহ আল-বুখারী: ২৬৭৪)।
৪। কোরআন কারীমে কোন মেয়ে মানুষের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে খৃষ্টানদের ভ্রান্ত দাবী “মারইয়াম (আ.) আল্লাহর স্ত্রী এবং ঈসা (আ.) তাঁর পুত্র” খন্ডন করার জন্য মারইয়াম (আ.) এর নাম ৩২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২৭) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) কারো জীবনে ভালো কিছু অর্জন হলে তার উপর তিনটি কাজ করা জরুরী: (ক) আল্লাহর আনুগত হওয়া, (খ) সাজদা করা এবং (গ) জামায়াতে সালাত আদায় করা।
(খ) গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজের দায়িত্বশীল নির্বাচন করতে একাধিক ব্যক্তিকে সমান যোগ্যতা সম্পন্ন মনে হলে অথবা কোন প্রতিযোগিতায় একাধিক প্রতিযোগী সমান অবস্থানে থাকলে ক্বোরআ বা লটারীর মাধ্যমে স্থান নির্ধারণ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৩৮-৪১) আয়াতাবলীর তাফসীর, আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: যাকারিয়্যা এবং ইয়াহইয়া (আ.) এর কাহিনী।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهُ قَالَ رَبِّ هَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ (38) فَنَادَتْهُ الْمَلَائِكَةُ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي فِي الْمِحْرَابِ أَنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكَ بِيَحْيَى مُصَدِّقًا بِكَلِمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَسَيِّدًا وَحَصُورًا وَنَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ (39) قَالَ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَقَدْ بَلَغَنِيَ الْكِبَرُ وَامْرَأَتِي عَاقِرٌ قَالَ كَذَلِكَ اللَّهُ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ (40) قَالَ رَبِّ اجْعَلْ لِي آيَةً قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ إِلَّا رَمْزًا وَاذْكُرْ رَبَّكَ كَثِيرًا وَسَبِّحْ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ (41)﴾ [سورة آل عمران: 38-41].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: যাকারিয়্যা এবং ইয়াহইয়া (আ.) এর কাহিনী।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৩৮। সেখানে যাকারিয়্যা তার রবের কাছে দোয়া করে বলেছিল: হে আমার রব! আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম বংশধর দান করুন, নিশ্চয় আপনি দোয়া শ্রবণকারী।
৩৯। অতঃপর ফেরেশতারা তাকে তার মেহরাবে সালাতে দাড়ানো অবস্থায় ডেকে বললো: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন ইয়াহইয়া সম্পর্কে, যে ঈসার সত্যায়নকারী, নেতা, নারী সম্ভোগমুক্ত এবং একজন নবী নেককারদের মধ্য থেকে।
৪০। সে বললো: হে আমার রব! কিভাবে আমার পুত্র হবে? অথচ আমার কাছে পৌছেছে বার্ধক্য, আর আমার স্ত্রী বন্ধা; তিনি বললেন: এভাবেই আল্লাহ যা চান তাই করেন।
৪১। সে বললো: হে আমার রব! আমাকে একটি নিদর্শন দেন, তিনি বললেন: তোমার নিদর্শন হলো: তুমি মানুষের সাথে তিন দিন পর্যন্ত ইশারা ব্যতীত কথা বলতে সক্ষম হবে না; আর স্মরণ করো তোমার রবকে অধিক পরিমাণে এবং তাসবীহ পড়ো সন্ধায় ও সকালে।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
মারইয়াম (আ.) এর কাছে বিভিন্ন ধরণের নেয়ামত দেখে বৃদ্ধ বয়েসে যাকারিয়্যা (আ.) এর মনে একজন সৎ সন্তানের বাসনা জাগলে তিনি আল্লাহর কাছে এ বলে দোয়া করলেন: হে আমার রব! আপনি আমাকে উত্তম বংশধর দান করুন। আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং দোয়া শ্রবণকারী।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুলের সুসংবাদ নিয়ে জিবরীল (আ.) কে পাঠালেন। যাকারিয়্যা (আ.) মেহরাবে সালাত অবস্থায় দাড়িয়ে দোয়া করতেছেন, এমন সময় ফেরেশতা তাকে ডেকে বললেন: আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ইয়াহইয়া নামক একজন সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যিনি ঈসা (আ.) এর সত্যায়নকারী, মানুষের উপর নেতৃত্ব দানকারী, জিতেন্দ্রিয় এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী।
মারইয়াম (আ.) এর কাছে নেয়ামত দেখে এতক্ষণ যাকারিয়া (আ.) আবেগাপ্লুত হয়ে আল্লাহর কাছে সন্তানের জন্য দোয়া করছিলেন। অতঃপর যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলেন, তখন তিনি ফেরেশতার কাছে জানতে চাইলেন, কিভাবে তার সন্তান হবে? অথচ সে নিজে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে এবং তার স্ত্রী বন্ধা, যার কোন সন্তান হয় না। তখন ফেরেশতা উত্তরে বললেন: এভাবেই তিনি কোন রকম কারণ ছাড়াই যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
অতঃপর যাকরিয়্যা (আ.) তার সন্তান হবে তার নিশ্চয়তা বিধানে আল্লাহর কাছে কিছু নিদর্শন চেয়ে দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে তিনটি কাজ দিলেন: (ক) তিন দিন পর্যন্ত কারো সাথে ইশারা ছাড়া কথা না বলা, (খ) এ সময়ে অধিক পরিমাণ আল্লাহর যিকির করা এবং (গ) সকাল-সন্ধা তাসবীহ পাঠ করা। (তাফসীর আল-মারাগী: ১৪৮-১৪৯, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১৩, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৫, আল-মোন্তাখাব: ১/৯১) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿ذُرِّيَّةً﴾ “বংশধর”, আয়াতাংশে ‘বংশধর’ দ্বারা দুইটি উদ্দেশ্য হতে পারে:
(ক) অনেক সন্তানসন্তুতি, যে অর্থের জন্য শব্দটি গঠিত হয়েছে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১৩) ।
(খ) একজন সন্তানকে বুঝানো হয়েছে। আর তিনি হলেন ‘ইয়াহইয়া’ (আ.)। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: (৩/২১৭) ।
﴿الْمَلَائِكَةُ﴾ “ফেরেশতা”, আয়াতাংশে ‘ফেরেশতা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: জিবরীল (আ.)। সম্মান প্রদর্শনের জন্য বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে; কারণ তিনি ফেরেশতাদের প্রধান ছিলেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: (৩/২১৭) ।
﴿بِكَلِمَةٍ مِنَ اللَّهِ﴾ “আল্লাহর কালেমার”, আয়াতাংশে ‘আল্লাহর কালেমা’ দ্বারা ‘ঈসা’ (আ.) কে বুঝানো হয়েছে; কারণ তাকে ‘কুন’ বা (হও) কালেমা দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: (৩/২১৭) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। আটত্রিশ নাম্বার আয়াত থেকে তিনটি বিষয় বুঝা যায়:
(ক) আল্লাহর কাছে সৎ সন্তান প্রার্থণা করা ইসলামে বৈধ, এটা নবী-রাসূলদের সুন্নাত। যেমন: উল্লেখিত আয়াতে যাকারিয়্যা (আ.) বৃদ্ধ বয়েসে আল্লাহর কাছে সৎ সন্তান প্রার্থণা করেছিলেন। এছাড়াও ইব্রাহীম (আ.) বৃদ্ধ বয়েসে আল্লাহর কাছে সন্তান প্রার্থণা করে ইসমাঈল ও ইসহাক (আ.) কে লাভ করেছিলেন। যারা নিজেদের জন্য সৎ সন্তান কামনা করে আল্লাহ তাদেরকে নিজের যোগ্য বান্দা বলে ঘোষণা দিয়েছেন:
﴿وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا﴾ [سورة الفرقان: ৭৪].
অর্থাৎ: “এবং যারা বলে: হে আমাদের রব! তুমি আমাদের স্ত্রী ও সন্তানসন্তুতিদের থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো, উপরন্তু তুমি আমাদেরকে মোত্তাক্বীদের ইমাম বানিয়ে দাও” (সূরা ফুরক্বান: ৭৪) ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) অসংখ্য হাদীসে তার উম্মতকে বেশী সন্তান গ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম একটি হাদীস হলো:
عَنْ مَعْقِلِ بْنِ يَسَارٍ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-، فَقَالَ: إِنِّي أَصَبْتُ امْرَأَةً ذَاتَ حَسَبٍ وَمَنْصِبٍ، إِلَّا أَنَّهَا لَا تَلِدُ، أَفَأَتَزَوَّجُهَا؟ فَنَهَاهُ، ثُمَّ أَتَاهُ الثَّانِيَةَ، فَنَهَاهُ، ثُمَّ أَتَاهُ الثَّالِثَةَ، فَنَهَاهُ، فَقَالَ: “تَزَوَّجُوا الْوَلُودَ الْوَدُودَ، فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمْ” (سنن النسائي: ৩২২৭).
অর্থাৎ: মাক্বাল ইবনু ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন আমি একজন উচ্চ বংশীয় ও সম্পদশালী নারীর সন্ধান পেয়েছি, তবে সে বন্ধা। আমি কি তাকে বিবাহ করতে পারি? অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বিবাহ করতে নিষেধ করলেন। অতঃপর দ্বিতীয় আরেকজন নারীকে বিবাহের অনুমতি চাইলে তাকেও বিবাহ করতে নিষেধ করলেন। অতঃপর তৃতীয় আরেকজন নারীকে বিবাহের অনুমতি চাইলে তাকেও বিবাহ করতে নিষেধ করলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: “তোমরা প্রেমময়ী এবং বেশী সন্তান ধারিণী নারীকে বিবাহ করো, নিশ্চয় আমি কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নিয়ে সংখ্যাধিক্য হতে চাই”। (সুনান আল-নাসায়ী: ৩২২৭) ।
(খ) দোয়ার সময় আল্লাহর সুন্দর সুন্দর গুণবাচক নামের অসিলা দেওয়া। পূর্বের আয়াতে হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) তার দোয়ায় আল্লাহর দুইটি গুণবাচক নাম ‘সামী’ এবং ‘আলীম’ এর অসীলা করেছিলেন। অত্র আয়াতে যাকারিয়্যা (আ.) ও সৎ সন্তানের জন্য দোয়া করার সময় আল্লাহর গুণবাচক নাম ‘সামী’ এর অসীলা দিয়েছেন। একই নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা সূরা আরাফ এর ১৮০ নাম্বার আয়াতে দিয়েছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২১২-২১৩) ।
(গ) অন্যের কাছে কোন ভালো কিছু দেখে আকৃষ্ট হয়ে তার ধ্বংস কামনা ব্যতিরেকে একই বস্তু আল্লাহর কাছে কামনা করা জায়েজ। এটাকে ‘গিবতাহ’ বলা হয়। আয়াতে দেখতে পাই যাকারিয়্যা (আ.) ‘মারইয়াম’ (আ.) এর কাছে আল্লাহর নেয়ামত দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনুরুপ সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও ‘গিবতাহ’ কে জায়েজ রেখেছেন। যেমন: একটি হাদীসে দেখতে পাই:
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يَقُولُ: “لاَ حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٍ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا، فَسَلَّطَهُ عَلَى هَلَكَتِهِ فِي الحَقِّ، وَرَجُلٍ آتَاهُ اللَّهُ حِكْمَةً، فَهُوَ يَقْضِي بِهَا وَيُعَلِّمُهَا” (رواه البخاري: ৭৩).
অর্থাৎ: “আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি “কেবল মাত্র দুই শ্রেণীর মানুষের প্রতি ঈর্ষা রাখা যেতে পারে: একজন এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন এবং ন্যায় পথে তা ব্যয় করার মতো ক্ষমতাবান করেছেন। অপরজন এমন ব্যক্তি যাকে আল্লাহ দ্বীনের জ্ঞান দান করেছেন আর তিনি সে অনুযায়ী ফয়সালা দেন ও অন্যকে তা শিক্ষা দেন” (সহীহ আল-মুসলিম: ৭৩) ।
ইবনু হাজার আসক্বালানী (র.) অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: হাসাদ বা হিংসা দুই প্রকার: (ক) বৈধ হিংসা, যার আরেক নাম ‘গিবতাহ’ এবং (খ) অবৈধ হিংসা। এখানে ‘হাসাদ’ দ্বারা প্রথম প্রকারকে বুঝানো হয়েছে। (ফাতহুল বারী, ইবনু হাজার: ১/১৬৭) ।
২। উনচল্লিশ নাম্বার আয়াতে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) দোয়া যখন নিয়ম মেনে, যথাসময়ে এবং যথোপযুক্ত পাত্র থেকে হয়, সে দোয়ার বিষয়টি যত কঠিনই হোক না কেন, তা সরাসরি কবুল করা হয়। যেমন: যাকারিয়্যা (আ.) বৃদ্ধ বয়েসে তার স্ত্রী বন্ধা হওয়া অবস্থায় সৎ সন্তানের জন্য দোয়া করা মাত্রই আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা পাঠিয়ে তাকে সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছেন।
(খ) দোয়ার অন্যতম নিয়ম হলো নির্জনে সালাতরত অবস্থায় একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে মনের কথা খুলে বলা। যাকারিয়্যা (আ.) ও সালাতে দাড়িয়ে নিরবে নির্জনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।
(গ) যাকারিয়্যা (আ.) এর দোয়া কবুল পূর্বক তাকে ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) এর সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, যার তিনটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে: তিনি ঈসা (আ.) এর সত্যায়নকারী, মানুষের উপর নেতৃত্ব দানকারী, জাগতিক লোভলালসা ও বেহায়াপনা থেকে মুক্ত এবং পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী।
৩। চল্লিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়:
(ক) আল্লাহর ওয়ালীদের অন্যতম একটি কারামত হলো: তারা মুস্তাজাবুদ দাওয়াত হয়ে থাকেন, অর্থাৎ: দোয়া করা মাত্রই আল্লাহ তাদের কবুল করে থাকেন। যেমন: যকারিয়্যা (আ.) একটি অসম্ভব বিষয়ে দোয়া করার পরও আল্লাহ তায়ালা অতি সহজে তা কবুল করে নিয়েছেন। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১৪) ।
(খ) আল্লাহ তায়ালা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তিনি চাইলে স্বাভাবিকের বিপরীত যে কোন কিছু করতে পারেন। যেমন: যাকারিয়্যা (আ.) এর বয়স ৯০ বছরের উপরে এবং তার স্ত্রী বন্ধা হওয়া সত্তে¡ও আল্লাহ তাদেরকে সন্তান দিয়েছেন।
৪। একচল্লিশ নাম্বার আয়াতে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) বিশেষ কিছু অর্জনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার পর তা পাওয়া পর্যন্ত তিনটি কাজ করা: (ক) মানুষের সাথে কম কথা বলা, (খ) এ সময়ে অধিক পরিমাণ আল্লাহর যিকির করা এবং (গ) সকাল-সন্ধা তাসবীহ পাঠ করা।
(খ) উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করার গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
(গ) ফজর ও আসর সালাতের ফযিলত বর্ণনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِي مُوسَى، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَالَ: “مَنْ صَلَّى البَرْدَيْنِ دَخَلَ الجَنَّةَ” (البخاري: ৫৭৪).
অর্থাৎ: আবু মূসা আল-আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি দুই শীতের সালাত অর্থাৎ ফজর ও আসরের সালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে” (সহীহ আল-বুখারী: ৫৭৪) । (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১৪) ।
৫। আয়াত সম্পৃক্ত ঘটনা:
প্রথমত: যাকারিয়্যা (আ.) এর জীবণী:
যাকারিয়্যা (আ.) এর নাম কোরআন কারীমের সূরা আলে-ইমরান, সূরা আনয়াম, সূরা মারয়াম এবং সূরা আনবিয়া এ মোট আট বার এসেছে। তার নসবনামা হলো: যাকারিয়্যা ইবনু হানা ইবনু মুসলিম ইবনু সাদূক ইবনু মাহমান ইবনু দাঊদ ইবনু সুলাইমান ইবনু মুসলিম… ইবনু সুলাইমান ইবনু দাঊদ। তার বংশ ধারাবাহিকতা দাঊদ (আ.) এর সাথে মিলেছে। তিনি হলেন আল্লাহর নবী ইয়াহইয়া (আ.) এর পিতা। তিনি বনী ইসরাঈলের নবী ছিলেন।
সহীহ মুসলিমের ২৩৭৯ নাম্বার হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভাষ্যানুযায়ী তিনি পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। মারইয়াম (আ.) এর জন্মের পর তার তত্বাবধানের দায়িত্ব যাকারিয়্যা (আ.) এর উপর অর্পিত হয়েছিল। এ সময়ে তিনি মারইয়াম (আ.) এর কাছে আল্লাহ প্রদত্ব অসংখ্য নেয়ামত দেখে বৃদ্ধ বয়েসে তার স্ত্রী বন্ধা থাকাবস্থায় তার মনে সৎ সন্তানের বাসনা জাগে। অতঃপর আল্লাহর কাছে সন্তানের আবেদন করলে তিনি তাকে ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) এর সুসংবাদ দিয়েছিলেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২১) । তার বিস্তারিত ঘটনা সূরা মারইয়াম এ বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: ইয়াহইয়া (আ.) এর জীবণী:
ইয়াহইয়া (আ.) এর নাম কোরআন কারীমের সূরা আলে-ইমরান, সূরা আনয়াম, সূরা মারয়াম এবং সূরা আনবিয়া এ মোট চার বার এসেছে। যাকারিয়্যা (আ.) এবং তার স্ত্রী বৃদ্ধ বয়েসে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তার চারটি গুণ বর্ণনা করেছেন: (ক) তিনি ঈসা (আ.) এর সত্যায়নকারী, (খ) মানুষের উপর নেতৃত্ব দানকারী, (গ) জাগতিক লোভলালসা ও বেহায়াপনা থেকে মুক্ত এবং (ঘ) পুণ্যবানদের মধ্যে একজন নবী। তিনি ত্রিশ বছরে উপণিত হওয়ার পূর্বেই নবী হিসেবে নির্বাচিত হন।
বলা হয় তৎকালীন ফিলিস্তীনের শাসক ‘হিরুদাস’ তার সুন্দরী কণ্যাকে ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) এর সাথে বিবাহের প্রস্তাব দেন। এতে ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) অস্বীকৃতি জানালে তাকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। তার শহীদ হওয়ার বছরেই ‘ঈসা’ (আ.) নবী ও রাসূল হিসেবে আগমণ করেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২২) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর কাছে সৎ সন্তান কামনা পূর্বক দোয়া করা।
(খ) সালাতে সাজদারত অবস্থায় আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দোয়া করা।
(গ) আল্লাহর কাছে দোয়া করার পর তিনটি কাজ করা: মানুষের সাথে কম কথা বলা, অধিক পরিমাণ আল্লাহর যিকির করা এবং সকাল-সন্ধা তাসবীহ পাঠ করা।
(ঘ) বেশী বেশী আল্লাহর যিকির ও তাসবীহ পাঠ করা।

সূরা আলে-ইমরানের (৩৫-৩৭) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: মারইয়াম (আ.) এর জন্মের কাহিনী।

By দৈনিক তাফসীর No Comments

﴿إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (35) فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ (36) فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِنْدَهَا رِزْقًا قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ (37)﴾ [سورة آل عمران: 35-37].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: মারইয়াম (আ.) এর জন্মের কাহিনী।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৩৫। যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল: হে আমার রব! নিশ্চয় আমি আমার গর্ভে যা আছে একান্তভাবে আপনার জন্য মানত করলাম; অতএব আপনি তা আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন, নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা মাহজ্ঞানী।
৩৬। অতঃপর যখন সে তা প্রসব করলো, তখন সে বললো: হে রব! নিশ্চয় আমি তা প্রসব করেছি একটি কন্যা, বস্তুত আল্লাহই ভালো জানেন যা সে প্রসব করেছে; আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মতো নয়, এবং নিশ্চয় আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম; আর নিশ্চয় আমি তার এবং তার বংশধরের ব্যাপারে আপনার কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় চাচ্ছি ।
৩৭। অতঃপর তার রব উত্তমভাবে তা কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমভাবে গড়লেন; এবং তার দায়িত্ব দিলেন যাকারিয়্যাকে; যখনই যাকারিয়্যা মেহরাবে তার কাছে প্রবেশ করতো, তখনই তার কাছে রিযিক উপস্থিত দেখতে পাইতো; সে বলতো: হে মারইয়াম! এগুলো কোথা থেকে আসে তোমার জন্য? সে বলতো: তা আল্লাহর পক্ষ থেকে; নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দেন ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
যারা ঈসা (আ.) কে ইলাহ এবং আল্লাহর ছেলে বলে বিশ্বাস করে তাদের যৌক্তিক জবাব দেওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা প্রদান পূর্বক আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে (সা.) সম্বোধন করে বলেছেন: তিনি যেন ইমরানের স্ত্রী হান্না বিনতে ফাক‚দের মানতের কথা স্মরণ করেন। যখন তিনি গর্ভে সন্তান ধারণ করলেন, তখন মানত করেছিলেন তার গর্ভের সন্তানকে বায়তুল মাক্বদাসের খেদমতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে তার মনের একান্ত ইচ্ছাকে কবূল করার জন্য এ বলে দোয়া করেছিলেন: “হে আল্লাহ! আমার মানতকে কবূল করুন, নিশ্চয় আপনি আমার মানতকে শুনেছেন এবং আমার মনের বাসনা সম্পর্কে জেনেছেন”।
অতঃপর হান্না বিনতু ফাক‚দ যখন দেখলেন তিনি মেয়ে সন্তান প্রসব করেছেন, তখন তিনি তার মানতের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে বলেছিলেন: হে আমার রব! আমি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি, সে তো বায়তুল মাকদাসে খেদমত করার উপযুক্ত নয়। বস্তুত: তিনি যা প্রসব করেছেন তার হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। তিনি একজন পুত্র সন্তানের আশা করেছিলেন; কারণ তার ধারনা ছিল বায়তুল মাকদাসে খেদমতের জন্য যে পরিমাণ শক্তি-সামর্থ দরকার, তা একজন মেয়ের পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। অবশেষে তিনি নবজাতকের নাম মারইয়াম রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন: “আল্লাহ যেন তাকে এবং তার বংশধরকে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় দান করেন”।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া ও মানতকে যথার্থভাবে কবুল করে মারইয়ামের লালন-পালনের দায়িত্বভার যাকারিয়্যা (আ.) এর উপর অর্পণ করেছিলেন। ফলে, তার তত্বাবধানে মাসজিদুল আক্বসার ভিতরে আল্লাহ প্রদত্ত জান্নাতী রিযিক আহরণ করে সে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। যাকারিয়্যাহ (আ.) যখনই মসজিদের মিহরাবে তার কাছে প্রবেশ করতেন, তখনই তার কাছে অমৌসুমী পবিত্র সুস্বাদু ফলমূল সহ বিভিন্ন ধরণের খাবার দেখতে পেতেন। আর তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করতেন এ সুস্বাদু খাবার কোথা থেকে আসে? তখন সে উত্তর দিতো, এ খাবার আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ১৪৪-১৪৫, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১১, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৪, আল-মোন্তাখাব: ১/৯০) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿امْرَأَتُ عِمْرَانَ﴾ “ইমরানের স্ত্রী”, আয়াতাংশে ‘ইমরান’ দ্বারা ইমরান ইবনু মাসানকে বুঝানো হয়েছে, যিনি মারইয়াম (আ.) এর পিতা এবং ঈসা (আ.) এর নানা। তিনি নবী ছিলেন না, বরং তিনি একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম হলো: হান্না বিনতু ফাক‚দ, যিনি যাকারিয়্যা (আ.) এর স্ত্রীর বোন ছিলেন। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১০) ।
﴿نَذَرْتُ﴾ “আমি মানত করেছি”, আরবী ভাষার শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হলো: আমি নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছি। ‘মানত’ এর শরয়ী অর্থ হলো: “শরীয়াতে ওয়াজিব নয় এমন কোন বিষয়কে নিজের উপর ওয়াজিব করে নেওয়া”।
মানত করার জন্য যে শব্দ ব্যবহার হয়: ‘নাযারতু লিল্লাহি কাযা’ অর্থাৎ: আমি আল্লাহর জন্য অনুরুপ করার মানত করলাম, ‘নাযারতু কাযা ওয়া কাযা’ অর্থাৎ: আমি অনুরুপ অনুরুপ করার মানত করলাম, ইত্যাদি।
মানতের হুকুম: মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব।
মানতের শর্ত: মানতের বিষয়টি এমন না হওয়া যা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্যতা হয়, এমন বিষয় হওয়া যা মানতকারীর স্বক্ষমতার ভিতরে থাকে, এমন বস্তুর মানত করা যার মালিক মানতকারী, মানত এমন জায়গার সাথে সম্পর্কিত না হওয়া যেখানে গায়রুল্লাহর ইবাদত হয় এবং মানত পালন করাকে কোন বিষয়ের সাথে লটকিয়ে না দেওয়া। (আলুকা পেইজ থেকে)।
﴿قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنْثَى وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى﴾ তাফসীরকারকগণ আয়াতাংশের দুইটি অর্থ করেছেন:
(ক) তিনি বললেন: হে আমার রব! আমি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি, সে তো বায়তুল মাকদাসে খেদমত করার উপযুক্ত নয়; কারণ একটি কন্যা সন্তান শক্তি-সামর্থের দিক থেকে একটি ছেলে সন্তানের সমান হতে পারে না। বস্তুত: তিনি যা প্রসব করেছেন তার হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৪) ।
(খ) তিনি বললেন: হে আমার রব! আমি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি। বস্তুত: তিনি যা প্রসব করেছেন তার হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। সে যে উদ্দেশ্যে পুত্র সন্তান চেয়েছিল তা বাস্তবায়নে পুত্র সন্তানের চেয়ে এই কন্যা সন্তানটিই বেশী উপকারে আসবে। (আল-মোন্তাখাব: ১/৯০) ।
﴿مُحَرَّرًا﴾ “স্বাধীনভাবে”, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: একনিষ্ঠভাবে বা ইখলাসের সাথে, যেখানে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা হয় না। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৩৫) ।
﴿وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا﴾ “এবং যাকারিয়্যাকে তার তত্বাবধানের দায়িত্ব দিলেন”, আয়াতাংশে ‘যাকারিয়্যাহ’ (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী। তিনি ‘সোলাইমান’ (আ.) এর বংশধর। ‘ইয়াহইয়া’ (আ.) এর পিতা এবং ‘মারইয়াম’ (আ.) এর খালু। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২০২; তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২১০) ।
﴿الْمِحْرَابَ﴾ “আল-মিহরাব”, মিহরাব হলো মসজিদের সামনের অংশে অবস্থিত উচু জায়গা, যা সাধারণ ইবাদতকারীদের জায়গা থেকে একটু আলাদা এবং তাদের আড়ালে থাকে। যাকারিয়া (আ.) মেহরাবে সিড়ি দিয়ে উঠতেন। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৪২) ।
﴿رِزْقًا﴾ “রিযিক”, আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি থেকে বুঝা যায় ‘রিযিক’ দ্বারা অমৌসুমী পবিত্র সুস্বাদু বিস্ময়কর ফলমূলকে বুঝানো হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২০৭) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পয়ত্রিশ নাম্বার আয়াতে নিম্নের কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইমরানের স্ত্রী হান্না বিনতু ফাক‚দ বন্ধা ছিলেন, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তার কোন সন্তান হয়নি। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের প্রতি প্রবল বাসনা জন্মালে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। অতঃপর তাঁর হুকুমে তিনি অন্তঃসত্ত¡ায় উপণিত হন।
(খ) হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) তার গর্ভাস্থ সন্তানকে আল্লাহর পথে মানত করেছিলেন। সুতরাং কোন মায়ের জন্য তার গর্ভাস্থ সন্তানকে আল্লাহর পথে মানত করা জায়েজ।
(গ) দোয়ার সময় আল্লাহর সুন্দর সুন্দর গুণবাচক নাম ব্যবহার করা উত্তম। হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) তার দোয়ায় আল্লাহর দুইটি গুণবাচক নাম ‘সামী’ এবং ‘আলীম’ এর অসীলা করেছিলেন। একই নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা সূরা আরাফ এর ১৮০ নাম্বার আয়াতে দিয়েছেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২১২-২১৩) ।
২। ছত্রিশ নাম্বার আয়াতে কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে হান্না বিনতু ফাক‚দ নবজাতকের নাম রেখেছিলেন ‘মারইয়াম’, পরবর্তীতে যার ঔরশে পিতা বিহীন ঈসা (আ.) এর জন্ম হয়েছিল।
(খ) নবজাতক কেমন হবে তার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছে রয়েছে, যা দুনিয়ার কোন মানুষ জানে না; কারণ আল্লাহ তায়ালা আয়াতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন নবজাতকের হাক্বীকত সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন।
(গ) নারীদের সম্মানিত করা হয়েছে, সকল নারী মানের দিক থেকে পুরুষের নীচে নয়, বরং কিছু নারী রয়েছে যারা অনেক পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
(ঘ) নবজাতক এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সুরক্ষার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা উত্তম; কারণ হান্না বিনতু ফাক‚দ নবজাতকের জন্য দোয়া করেছিলেন।
৩। সাইত্রিশ নাম্বার আয়াতে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) আল্লাহ তায়ালা হান্না বিনতু ফাক‚দ (র.) এর দোয়া উত্তমরুপে কবূল করেছিলেন।
(খ) মারইয়ামের (আ.) তত্বাবধানের দায়িত্ব যাকারিয়্যা (আ.) এর উপর অর্পিত হয়েছিল।
(গ) মারইয়ামকে (আ.) আল্লাহ তায়ালা বিশেষ জাতের খাবার বিযিক হিসেবে প্রদান করেছিলেন। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহর ওয়ালীদের কারামাত সত্য।
৪। উল্লেখিত আয়াতবলীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর রিসালাতের সত্যতার প্রমাণ রয়েছে; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘উম্মী’ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে না জানালে এ ঘটনা জানা তার পক্ষে কখনও সম্ভব হত না। এ জন্যই ঘটনা বর্ণনার উপসংহারে ৪৪ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: “এটা অদৃশ্য সংবাদ, যা আপনাকে প্রত্যাদেশ করেছি”। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩১২) ।
৫। উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মানতের ব্যাপারে আলোচনা এসেছে, এ সম্পৃক্ত মাসয়ালা নি¤েœ:
‘মানত’ এর শরয়ী অর্থ: “শরীয়াতে ওয়াজিব নয় এমন কোন বিষয়কে নিজের উপর ওয়াজিব করে নেওয়া”।
মানত করার জন্য যে শব্দ ব্যবহার হয়: ‘নাযারতু লিল্লাহি কাযা’ অর্থাৎ: আমি আল্লাহর জন্য অনুরুপ করার মানত করলাম, ‘নাযারতু কাযা ওয়া কাযা’ অর্থাৎ: আমি অনুরুপ অনুরুপ করার মানত করলাম, ইত্যাদি।
মানতের হুকুম: মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব।
মানতের শর্ত:
(ক) মানতের বিষয়টি এমন না হওয়া যা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর অবাধ্যতা হয়।
(খ) এমন বিষয় হওয়া যা মানতকারীর স্বক্ষমতার ভিতরে থাকে।
(গ) এমন বস্তুর মানত করা যার মালিক মানতকারী।
(ঘ) মানত এমন জায়গার সাথে সম্পর্কিত না হওয়া যেখানে গায়রুল্লাহর ইবাদত হয়।
(ঘ) মানত পালন করাকে কোন বিষয় অর্জনের সাথে শর্তযুক্ত না করা। (আলুকা পেইজ থেকে)।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ভালো কাজের মানত করা।
(খ) গুরুত্বপূর্ণ কাজ সফল করতে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
(গ) নবজাতক যেন শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহর পথে বেরে উঠে সে জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা।
(ঘ) আল্লাহর ওয়ালীদের কারামাত সত্য, এ কথা বিশ্বাস করা।

error: Content is protected !!