Skip to main content

সূরা আলে-ইমরান এর (৭-৯) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্য বিষয়: কোরআনে ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত।

By February 20, 2024March 20th, 2024দৈনিক তাফসীর1 min read

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ (7) رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ (8) رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ (9) [سورة آل عمران: 7-9]

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: কোরআনে মুহকাম এবং মুতাশাবিহ্ আয়াত।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭। তিনিই তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন, তার মধ্যে আছে মুহকাম আয়াতসমূহ। সেগুলো কিতাবের মূল আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ্। ফলে, যাদের ক্বলবে বক্রতা আছে, তারা ফিতনা সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহ্ আয়াতের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত। বস্তুত বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে।
৮। হে আমাদের রব! আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বলবকে বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।
৯। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি একদিন মানবজাতিকে শমবেত করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। (আল-বায়ান ফাউন্ডেশন এবং তাফসীর আহসানুল বায়ান) ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
পূর্ববর্তী আয়াতের ধারাবাহিকতায় অত্র আয়াতসমূহেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর একাত্ববাদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলছেন, তিনি এমন একক সত্বা যিনি মোহাম্মদ (সা.) এর উপর এমন কিতাব নাযিল করেছেন, যার আয়াতসমূহ দুই ভাগে বিভক্ত:
(ক) মুহকাম: এমন আয়াত যার অর্থ খুবই স্পষ্ট, যাতে দ্বিতীয় কোন অর্থের সম্ভাবনা থাকে না। এই আয়াতগুলোতে সাধারণত ফারায়েজের বিধান, আক্বায়েদ, ইবাদত, আদেশ-নিষেধ এবং হালাল-হারামের বর্ণনা এসেছে। এগুলো হলো কিতাবের মূল, কোন বিষয়ে মতবিরোধ হলে এর দিকে ফিরতে হবে।
(খ) মুতাশাবিহ: এমন আয়াত যার একাধিক অর্থ থাকে, যার বাহ্যিক অর্থ যে অর্থ উদ্দেশ্য করা হয়েছে তার বিপরীত এবং তার অর্থ বাহ্যিকভাবে কখনও মুহকাম আয়াতের অনুকুলে হয় আবার কখনও বিপরীত হয়।
একারণে, যাদের ক্বলবে বক্রতা আছে, তারা ফিতনা সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে ‘মুতাশাবিহ্’ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে থাকে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত। বস্তুত বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে।
আর জ্ঞানবান মানুষরা ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে তাওফীকের প্রত্যাশায় দুইটি দোয়া করেন:
(ক) হে আমাদের রব! আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বলবকে বক্র করবেন না এবং এ আয়াতগুলো বুঝার ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।
(খ) হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি একদিন মানবজাতিকে সমবেত করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৫৩-১৫৪, আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৭, তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫০) ।

আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(الْكِتَابَ) ‘আল-কিতাব’, আয়াতাংশ দ্বারা ‘কোরআন মাজীদ’ কে বুঝানো হয়েছে।

(مُحْكَمَاتٌ) ‘মুহকামাত’, আয়াতে ‘মুহকাম’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে তাফসীরকারকদের থেকে আটটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ‘মুহকাম’ দ্বারা ‘নাসিখ’ বা রহিতকারী আয়াতসমূহকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
(খ) ‘হালাল-হারাম’ সংশ্লিষ্ট আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(গ) যে সকল আয়াতের ব্যাখ্যা আলেমগণ জানেন, সে সকল আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(ঘ) যে সকল আয়াত রহিত হয় নাই, সে সকল আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(ঙ) কোরআন মাজীদের ঐ সকল শব্দকে বুঝানো হয়েছে, যা বারবার আসেনি।
(চ) যে সকল আয়াত এতই স্পষ্ট যে তা বুঝতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না।
(ছ) হুরুফে মুকাত্বায়াত ছাড়া কোরআনের সকল আয়াতকে বুঝানো হয়েছে।
(জ) আদেশ-নিষেধ, হালাল-হারাম এবং ওয়াদা-সতর্কতা সম্পর্কিত আয়াত। (যাদ আল-মাসীর, ইবনু আল-জাওযী: ১/২৫৮) ।
ইমাম নাহহাস (র.) বলেন: ‘মুহকাম’ হলো ঐ সকল আয়াত যা সয়ং স্পষ্ট এবং পাঠকের কাছেও স্পষ্ট। আর ‘মুতাশাবিহ’ হলো ঐ সকল আয়াত যা সয়ং অস্পষ্ট এবং পাঠকের কাছেও অস্পষ্ট। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/১১) ।

(أُمُّ الْكِتَابِ) ‘কিতাবের মা’, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস এবং ইবনু জুবাইরের ভাষ্যমতে এখানে আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘কিতাবের মূল’। (যাদ আল-মাসীর, ইবনু জাওযী: ১/২৫৮) । সুতরাং কোন বিধান বুঝতে, হালাল-হারামের পার্থক্য করতে, কোন বিষয়ের বিরোধ মিটাতে এবং অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝতে ‘মুহকাম’ আয়াতের দিকে ফিরতে হবে। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/২৮) ।

(مُتَشَابِهَاتٌ) ‘মুতাশাবিহাত’, আয়াতে ‘মুতাশাবিহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে তাফসীরকারকদের থেকে সাতটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ‘মুতাশাবিহ’ দ্বারা ‘মানসূখ’ বা রহিত হয়ে যাওয়া আয়াতসমূহকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
(খ) এমন আয়াত যার তাফসীর জানার কোন পথ নেই।
(গ) ‘মুতাশাবিহ’ হলো হুরূফ মোকাত্বায়াত।
(ঘ) ‘মুতাশাবিহ’ হলো এমন আয়াত যার অর্থ অন্য অর্থের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
(ঙ) ‘মুতাশাবিহ’ দ্বারা ঐ সকল শব্দকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যা কোরআনে বারবার এসেছে।
(চ) যে সকল আয়াত বুঝতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার হয়।
(ছ) ‘মুতাশাবিহ’ হলো: কোরআনে বর্ণিত ঘটনা এবং উদাহরণ। (যাদ আল-মাসীর, ইবনু আল-জাওযী: ১/২৫৯) ।

(زَيْغٌ) ‘বক্রতা’, আয়াতাংশের অর্থ কি? এ সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন: এর অর্থ হলো: কোন এক দিকে ঝুকে পড়া। এর আরেকটি অর্থ হলো: ‘মূল উদ্দেশ্যকে ছেড়ে দেওয়া’। (তাফসীরে কুরতুবী: ৪/১৩) । কামেলা আল-কাওয়ারী বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সত্য থেকে বিপরীত দিকে ঝুকে পড়া। (তাফসীর গরীব আল-কুরআন: ৩/৭) ।

(الْفِتْنَةِ) ‘ফিতনা’, অত্র শব্দটির মূল অর্থ হলো: ‘দুর্বল গুণের স্বর্ণকে তার ভালো গুণ দেখাতে আগুনে জালানো’। তবে আয়াতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: বিভ্রান্ত করা বা সত্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগানো। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/৩০) ।

(ابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ) ‘তার ব্যাখ্যার সন্ধানে’, আয়াতাংশ দ্বারা কয়েকটি উদ্দেশ্য হতে পারে:
(ক) ‘মুতাশাবিহ আয়াতকে নিজের বাতিল দলের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা পেশ করা’। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫০) ।
(খ) ‘মুতাশাবিহ আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করা’। (আল-মোন্তাখাব: ১/৭১) ।
(গ) আবু বকর আল-জাযায়েরী (র.) বলেন: নিজের ভ্রান্ত আক্বীদাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুতাশাবিহ আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করা’। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/২৮৬) ।

উল্লেখিত আয়াতবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলী তথা (১-৬) নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালার একাত্বাবাদের স্বপক্ষে চারটি দলীল পেশ করা হয়েছে। অত্র আয়াতাবলী তথা (৭-৯) নাম্বার আয়াতেও তাঁর একাত্ববাদের স্বপক্ষে দলীল বর্ণনার পাশাপাশি যারা তাঁর একাত্ববাদকে অস্বীকার করার লক্ষ্যে কোরআনের আয়াতকে অপব্যাখ্যাপূর্বক দলীল পেশ করবে তাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। সূতরাং পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতের সম্পর্ক স্পষ্ট। (আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন)।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। সাত নাম্বার আয়াতে আল্লাহ কোরআনের আয়াতাবলীকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন:
(ক) মুহকাম আয়াত, এ ধরণের আয়াতের একটি মাত্র অর্থ থাকে এবং তা এতই স্পষ্ট যে বুঝতে কোন ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না।
(খ) মুতাশাবিহ আয়াত, এ ধরণের আয়াতে একাধিক অর্থ থাকে এবং তা অত্যাধিক অস্পষ্টতার কারণে বুঝতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার হয়।
দ্বিতীয় প্রকার আয়াত বুঝে না আসলে প্রথম প্রকার আয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
এখানে একটি উহ্য প্রশ্ন হতে পারে যে উল্লেখিত আয়াতে কোরানের আয়াতাবলীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’, কিন্তু সূরা হুদ এর প্রথম আয়াতে দেখতে পাই আল্লাহ পুরো কোরআনকে ‘মুহকাম’ বলেছেন: (كِتابٌ أُحْكِمَتْ آياتُهُ) [سورة هود: ১]. অর্থাৎ: “এ কোরআন হচ্ছে এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহ স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে” (সূরা হুদ: ১) । এবং সূরা যুমার এর তেইশ নাম্বার আয়াতে পুরো কোরআনকে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত বলেছেন: (اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتاباً مُتَشابِهاً) [سورة الزمر: ২৩]. অর্থাৎ: “আল্লাহ তায়ালা সর্বোৎকৃষ্ট বাণী নাযিল করেছেন, তা এমন কিতাব যার প্রতিটি বাণী পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যশীল” (সূরা যুমার: ২৩) । এখন এর মধ্যকার সমাধান কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে তাফসীরকারকগণ বলেন: ‘সূরা হুদ’ এর আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: কোরআন ভাষাশৈলীর এক উন্নত শিখরে আরোহণ করার কারণে তা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত , প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং তার বর্ণনা খুবই স্পষ্ট। এবং সূরা যুমার এর আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: কোরআনের বর্ণনা ভঙ্গি এতই উচ্চ মানের যে তার একাংশ আরেক অংশের সাথে অর্থের দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩/১৫২) ।

২। যারা নিজের মত, দল, ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদির পক্ষে দলীল পেশ করার জন্য বহু অর্থযুক্ত ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত থেকে নিজেদের সুবিধামত অর্থটিকে গ্রহণ করে তাদের জন্য সাত নাম্বার আয়াতের শেষাংশে সতর্ক বার্তা রয়েছে। মূলতঃ খৃষ্টানরা ‘মুহকাম’ আয়াতকে বাদ দিয়ে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দ্বারা ঈসা (আ.) কে আল্লাহর রুহ এবং পুত্র সাব্যস্ত করলে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের জবাব দেন। যেমন: ‘সূরা যুখরুফ’ এর ৫৯ নাম্বার ‘মুহকাম’ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে:
(إِنْ هُوَ إِلَّا عَبْدٌ أَنْعَمْنَا عَلَيْهِ وَجَعَلْنَاهُ مَثَلًا لِبَنِي إِسْرَائِيلَ) [سورة الزخرف: ৫৯].
অর্থাৎ: “মূলত সে (ঈসা) ছিলো আমারই একজন বান্দা, যার উপর আমি অনুগ্রহ করেছিলাম” (সূরা যুখরুফ: ৫৯) । এবং ‘সূরা নিসা’ এর ১৭২নং ‘মুহকাম’ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে:
(لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ) [سورة النساء : ১৭২].
অর্থাৎ: “ঈসা নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরিচয় দিতে কখনও লজ্জাবোধ করেনি এবং আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতারাও এ বিষয়ে লজ্জাবোধ করেনি” (সূরা নিসা: ১৭২)।
খৃষ্টানরা উল্লেখিত দুইটি সহ অসংখ্য ‘মুহকাম’ আয়াতকে পাশ কাটিয়ে ঈসা (আ.) আল্লাহর রুহ হওয়ার ব্যাপারে ‘সূরা নিসা’ এর নি¤েœর ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছে:
(إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ) [سورة النساء: ১৭১].
অর্থাৎ: “মারইয়ামের পুত্র ঈসা ছিলো আল্লাহ রাসূল ও তাঁর বাণী, যা তিনি মারইয়ামের ওপর প্রেরণ করেছেন এবং সে ছিলো আল্লাহ কাছ থেকে পাঠানো এক ‘রূহ’” (সূরা নিসা: ১৭১)।
আমাদের সমাজেও কিছু সুযোগ সন্ধানী এবং দুনিয়াবী স্বার্থান্বেষী নামধারী আলেম ‘মুহকাম’ আয়াতকে বাদ দিয়ে বহু অর্থযুক্ত ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত থেকে নিজেদের সুবিধামত অর্থ গ্রহণ করে নিজের দল ও মতের স্বপক্ষে দলীল পেশ করে থাকে। যেমন: রাসূলুল্লাহ (সা.) মাটির তৈরি একজন মহা মানব এর স্বপক্ষে অনেকগুলো ‘মুহকাম’ আয়াতের মধ্যে অন্যতম হলো ‘সূরা কাহ্ফ’ এর ১১০ এবং ‘সূরা ফুসসিলাত’ এর ৬ নাম্বার আয়াত, যেখানে বলা হয়েছে:
(قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ) [سور الكهف: ১১০/ سورة فصلت: ৬].
অর্থাৎ: “হে নবী! তুমি বলো, আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ, তবে আমার উপর ওহী নাযিল হয়, আর সে ওহীর মূল কথা হচ্ছে তোমাদের মাবুদ হচ্ছে একজন” (সূরা কাহ্ফ: ১১০/ সূরা ফুসসিলাত: ৬) ।
একদল নামধারী আলেম উল্লেখিত ‘মুহকাম’ আয়াতকে পাশ কাটিয়ে ‘সূরা মায়িদা’ এর ১৫ নাম্বার ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দ্বারা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নুরের তৈরি সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে, যেখানে বলা হয়েছে:
(قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ) [سورة المائدة: ১৫].
অর্থাৎ: “অবশ্যই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আলোকবার্তিকা এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসে গেছে” (সূরা মায়িদা: ১৫) ।
অথচ নিয়ম হলো: কোন বিধান বুঝতে, হালাল-হারামের পার্থক্য করতে, কোন বিষয়ের বিরোধ মিটাতে এবং অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝতে ‘মুহকাম’ আয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/২৮) ।

৩। একটি উহ্য প্রশ্ন ও তার উত্তর: যদি ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দিয়ে কোন মাসয়ালা সাব্যস্ত হওয়া নিয়ে মতবিরোধ হয় এবং একই বিষয়ে কোন ‘মুহকাম’ আয়াত পাওয়া যায়, তখন করণীয় কি?
এ প্রশ্নের উত্তরে সয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের বিপরীতে কোন ‘মুহকাম’ আয়াত পাওয়া গেলে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতকে তার জায়গায় রেখে তার প্রতি ঈমান আনয়ন পূর্বক ‘মুহকাম’ আয়াতের উপর আমল করতে হবে। যেমন: একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ أَبِي شُعَيْبٍ، قَالَ: خَرَجَ مِنْ وَرَاءِ حُجْرَاتِ رَسُولِ الله -صلى الله عليه وسلم- قَوْمٌ يُجَادِلُونَ بِالْقُرْآنِ، فَخَرَجَ مُحْمَرَّةٌ وَجْنَتَاهُ كَأَنَّمَا يَقْطِرَانِ دَمًا فَقَالَ: “يَا قَوْمِ لَا تُجَادِلُوا بِالْقُرْآنِ، فَإِنَّمَا ضَلَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِجِدَالِهِمْ إِنَّ الْقُرْآنَ لَمْ يَنْزِلْ لَيُكَذِّبَ بَعْضُهُ بَعْضًا، وَلَكِنْ نَزَلَ لَيُصَدِّقَ بَعْضُهُ بَعْضًا، فَمَا كَانَ مِنْ مْحُكَمِهِ فَاعْمَلُوا بِهِ، وَمَا كَانَ مِنْ مُتَشَابِهِهِ فَآمِنُوا بِهِ” (بغية الباحث عن زوائد مسند الحارث: ৭৩৫).
অর্থাৎ: “আবু শুয়াইব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হুজরা মোবারকের পিছনে কিছু লোক কোরআনের আয়াত নিয়ে মতবিরোধ করছিলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তা শুনে এমনভাবে রাগন্বিত হয়ে বের হয়েছিলেন যে তার দুই গাল লাল রং ধারণ করছিল আর মনে হচ্ছিলো রক্তের ফোটা গড়িয়ে পড়ছে। অতঃপর বললেন: হে লোকসকল! তোমরা কোরআন নিয়ে মতবিরোধ করো না, নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি মতবিরোধ করে ধ্বংস হয়েছে। জেনে রেখো, কোরআনের একাংশকে অপর অংশ দ্বারা মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার জন্য তা অবতীর্ণ হয়নি, বরং একাংশকে অপরাংশ দ্বারা সত্যায়িত করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং ‘মুহকাম’ আয়াতের আমল করো এবং ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করো”। (বুগইয়াতুল হারিস আন যাওয়ায়েদ মুসনাদ আল-হারিস: ৭৩৫)।

৪। আরেকটি উহ্য প্রশ্ন ও তার উত্তর, এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন কোরআনের ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা সকলে জানেন কি না? এর উত্তর হলো: ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত তিন প্রকার:
(ক) এমন আয়াত যার ব্যাখ্যা আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মাধ্যমে যতটুকু জানিয়েছেন তার চেয়ে বেশী দুনিয়ার কোন মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না। যেমন: আল্লাহর জাতের জ্ঞান, তাঁর গুণের হাকীকাত, কিয়ামতের জ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কিত আয়াত।
(খ) এমন আয়াত যার ব্যাখ্যা একটু চিন্তা গবেষণা ও অধ্যায়নের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। আরবী ভাষা এবং ব্যাকরণগত কারণে আয়াতের মধ্যে যে অস্পষ্টতা তৈরি হয়। যেমন: ব্যাকরণগত কারণে আয়াতের মধ্যে শব্দ আগে পরে হওয়া, অথবা শব্দ উহ্য থাকা ইত্যাদি।
(গ) এমন আয়াত যার ব্যাখ্যা আলেমগণ অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে জানতে পারেন। যেমন: বিজ্ঞান এবং মুয়ামালাত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ। (আল-তাফসীর আল-ওয়াসীত, মোহাম্মদ তানতাভী: ২/২৯) ।
উল্লেখিত তিন প্রকারের মধ্যে প্রথম প্রকারের ব্যাখ্যা কেবল আল্লাহ তায়ালা জানেন, আর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রকারের ব্যাখ্যা আলেমগণও জানেন। এ কথার স্বপক্ষে দলীল হলো:
(وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا) [سورة آل عمران: ৭].
তাফসীরকারকগণ অত্র আয়াতাংশের দুইটি অর্থ করেছেন:
(ক) অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা আলেম, তারা বলে: আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত।
(খ) অথচ আল্লাহ এবং আলেম ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। সবকিছুই আমাদের রবের পক্ষ থেকে আগত।
দুইটি অর্থকে সমন্বয় করে বলা যায় প্রথম প্রকার ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা আলেমগণও জানেন। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।

৫। সাত নাম্বার আয়াতের শেষাংশে এবং (৮-৯) নাম্বার আয়াতে যে সকল আলেম ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাখ্যা জানেন তাদের দুইটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) তারা ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের পুরো বিষয়টা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে। কোন একটি ব্যাখ্যায় উপণিত হতে পারলে তা আল্লাহর দিকে হাওলা করে দেয়, আর কোন ব্যাখ্যায় পৌছতে না পারলে তা যথাস্থানে রেখে এর প্রতি তার ঈমানকে আরো সূদৃঢ় করে।
(খ) ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের ব্যাপারে গোমরাহীতে পতিত হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় পার্থনা করে এবং পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের আরো তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন:
(গ) তারা সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্ভন করে।
(ঘ) কথায় ও কাজে সত্যবাদী হয়।
(ঙ) পেট ও গোপনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে। যেমন: আবু দারদা, আবু উমামা, ওয়াথিলা ইবনু আসকা এবং আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, তারা বলেন:
سُئِلَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- مَنِ الرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ؟ قَالَ: هُوَ مَنْ بَرَّتْ يَمِينُهُ، وَصَدَقَ لِسَانُهُ، وَعَفَّ بَطْنَهُ وَفَرْجَهُ، فَذَاكَ الرَّاسِخُ (المعجم الكبير للطبراني: ৭৬৫৮).
অর্থাৎ: “রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোরআনে বর্ণিত গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেম কারা? তিনি উত্তর দিলেন: যে আলেম ন্যায়পরায়ণ, যার জিহŸা সত্যবাদী এবং যার পেট ও গোপনাঙ্গ পবিত্র সেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী আলিম” (আল-মুজাম আল-কাবীর লিত তাবারানী: ৭৬৫৮) ।

৬। মানুষের অন্তরের ব্যাধিসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো: ‘অন্তরের পদস্খলন’ অর্থাৎ: সময়ের পরিবর্তনের সাথে সত্য থেকে বাতিলের দিকে ঝুকে পড়া। এ ধরণের রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) আট নাম্বার আয়াত তেলওয়াতের মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। যেমন: একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يَقُولُ: “يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ، ثُمَّ قَرَأَ: ﴿رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا﴾ [آل عمران: ৮] إِلَى آخِرِ الْآيَةِ” (مسند إسحاق بن راهويه: ১৮৭৯].
অর্থাৎ: “উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা বলতেন:
“يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ”
(হে অন্তরের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর অটল রাখুন)।
দোয়াটি পাঠ করার পর সূরা আলে-ইমরান এর নিম্নের আয়াতটি পাঠ করতেন:
(رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ).
(হে আমাদের রব! আপনি হেদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বলবকে বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা)” (মুসনাদে ইসহাক ইবনু রাহউইহ: ১৮৭৯) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস করা।
(খ) নিজের দল ও মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘মুহকাম’ আয়াত থাকা অবস্থায় ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত দিয়ে দলীল প্রদান না করা।
(খ) কোরআনে ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’ দুই প্রকার আয়াত বিদ্যমান, এ কথা বিশ্বাস করা।
(গ) কোন মাসয়ালার হুকুম ‘মুহকাম’ আয়াতে পাওয়া গেলে, সে ব্যাপারে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াতের দিকে না যাওয়া।
(ঘ) হেদায়েতের উপর অটল থাকার জন্যে নিম্নের আয়াতটি সর্বদা পাঠ করা:
(رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ).

Leave a Reply

error: Content is protected !!