Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের ৭৮ নাম্বার আয়াতের তাফসীর, আয়াতের আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর প্রতি  ইহুদীদের মিথ্যাচারিতা।

﴿وَإِنَّ مِنْهُمْ لَفَرِيقًا يَلْوُونَ أَلْسِنَتَهُمْ بِالْكِتَابِ لِتَحْسَبُوهُ مِنَ الْكِتَابِ وَمَا هُوَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَقُولُونَ هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَمَا هُوَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (78)﴾ [سورة آل عمران: 78]

আয়াতের আলোচ্যবিষয়: আল্লাহর প্রতি  ইহুদীদের মিথ্যাচারিতা।

আয়াতের সরল অনুবাদ:
৭৮। আর নিশ্চয় তাদের মধ্যে এমন একটি দল রয়েছে যারা কিতাব পাঠকালে তাদের জিহŸা বাঁকা করে, যেন তুমি তাকে কিতাবের অংশ মনে করো, কিন্তু তা কিতাবের অংশ নয়, আর তারা বলে: তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি, আর তারা জেনে-বুঝে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলে।

আয়াতের ভাবার্থ:
রাসূলুল্লাহর (সা.) সামসাময়িক মদীনার ইহুদী পন্ডিতদের তাওরাত বিকৃতি করার একটি অপকৌশলকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের সামনে তাদের মনগড়া বানোয়াট কথাগুলো এমনভাবে এনিয়ে বিনিয়ে জিহŸাকে আকিয়ে বাঁকিয়ে উপস্থাপন করে, যাতে তারা এগুলোকে তাওরাতের অংশ মনে করে। অনুরুপভাবে তারা দাবী করে এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। এভাবে তারা জেনে-বুঝে আল্লাহ তায়ালার সাথে মিথ্যাচারিতা করে থাকে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৬, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৬০, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৮) ।

আয়াতের বিরল শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْكِتَابِ﴾ “কিতাব”, আয়াতটিতে তিনবার ‘কিতাব’ শব্দটি এসেছে, যার দ্বারা ‘তাওরাত’ কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৬৮) ।
﴿لَفَرِيقًا﴾ “একটি দল”, আয়াতটিতে দল দ্বারা কাব বিন আশরাফ, মালিক ইবনু সাইফ এবং হুয়াই ইবনু আখতাব প্রমুখকে বুজানো হয়েছে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২৪) ।

(৭৮) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: ইহুদীদের তৃতীয় এ গ্রæপটি আল্লাহর ব্যাপারে এমন বিষয়ে মিথ্যা অপবাদ দিতো, যে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। তারা ইসলামের ঘোর শত্রæ কা’ব বিন আশরাফের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে তাওরাতকে বিকৃতি করতো এবং এমন কিতাব রচনা করতো, যেখানে রাসূলুল্লাহর (সা.) গুণাবলী এবং তার আগমণের সুসংবাদ সম্বলিত আয়াতাবলীকে পরিবর্তন করা হত। এমনকি এগুলোকে বনী কুরাইজা গোত্র গ্রহণ করে তাদের নিজস্ব লিখিত কিতাবের সাথে মিশ্রন করে ফেলতো। (তাফসীর আল-কাশশাফ: ১/৩৩১) ।

আয়াতের শিক্ষা:
১। উল্লেখিত আয়াতে তাওরাত বিকৃতি করার অভিনব একটি পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নি¤েœর বিষয়গুলোকে তারা অনুসরণ করে:
(ক) তারা সাধারণ মানুষের সামনে মনগড়া বানোয়াট কথাগুলো এনিয়ে বিনিয়ে জিহŸাকে আকিয়ে বাঁকিয়ে উপস্থাপন করে।
(খ) এমন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে যাতে সাধারণ মানুষ এগুলোকে তাওরাতের অংশ মনে করে।
(গ) তাদের বানোয়াট কথাগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে বলে দাবী করে, কিন্তু তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি।
(ঘ) তারা জেনে-বুঝে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে।
২। তাদের জিহŸা নেড়ে এনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার কিছু উদাহরণ:
প্রথমত: তারা রাসূলুল্লাহকে (সা.) সালাম প্রদানের সময় “আসসালামু আলাইকুম” না বলে “আসসামু আলাইকুম” বলতো, যার অর্থ হলো: তোমার প্রতি মৃতু আসুক। যেমন একটি হাদীসে এসেছে:
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا: أَنَّ اليَهُودَ أَتَوُا النَّبِيَّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-، فَقَالُوا: السَّامُ عَلَيْكَ، قَالَ: “وَعَلَيْكُمْ” فَقَالَتْ عَائِشَةُ: السَّامُ عَلَيْكُمْ، وَلَعَنَكُمُ اللَّهُ وَغَضِبَ عَلَيْكُمْ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-: “مَهْلًا يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالعُنْفَ، أَوِ الفُحْشَ” قَالَتْ: أَوَلَمْ تَسْمَعْ مَا قَالُوا؟ قَالَ: “أَوَلَمْ تَسْمَعِي مَا قُلْتُ، رَدَدْتُ عَلَيْهِمْ، فَيُسْتَجَابُ لِي فِيهِمْ، وَلاَ يُسْتَجَابُ لَهُمْ فِيَّ” (متفق عليه).
অর্থাৎ: “আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: একবার একদল ইহুদী রাসূলুল্লাহর (সা.) নিকট এসে সালাম দিতে গিয়ে বললো: ‘আসসালামু আলাইকা’। তিনি বললেন: ‘ওয়ালাইকুম’। কিন্তু আয়েশা (রা.) বললেন: “আসসামু আলাইকুম ওয়া লায়ানাকুমুল্লাহ ওয়া গাযিবা আলাইকুম” (তোমরা ধ্বংস হও, আল্লাহ তোমাদের উপর লানাত করুন, আর তোমাদের উপর গযব অবতীর্ণ করুন)। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: হে আয়েশা তুমি থামো! তুমি ন¤্রতা অবলম্বন করো, আর তুমি কঠোরতা বর্জন করো। আয়েশা (রা.) বললেন: তারা কি বলেছে আপনি কি শুনেননি? তিনি বললেন: আমি যা বলেছি, তা কি তুমি শুননি? আমি তো তাদের কথাটা তাদের উপরই ফিরিয়ে দিলাম। কাজেই তাদের উপর আমার বদ্ দুয়া কবুল হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তাদের বদ দুয়া কবুল হবে না”। (বুখারী ও মুসলিম) ।
দ্বিতীয়ত: তারা রাসূলুল্লাহকে (সা.) দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে ‘রায়িনা’ সহজভাবে না বলে, ‘রায়েনা’ বলে, যার অর্থ দাড়ায় ‘আমাদের রাখাল’। এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে:
﴿مِنَ الَّذِينَ هادُوا يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَواضِعِهِ وَيَقُولُونَ سَمِعْنا وَعَصَيْنا، وَاسْمَعْ غَيْرَ مُسْمَعٍ، وَراعِنا، لَيًّا بِأَلْسِنَتِهِمْ، وَطَعْناً فِي الدِّينِ، وَلَوْ أَنَّهُمْ قالُوا: سَمِعْنا وَأَطَعْنا، وَاسْمَعْ وَانْظُرْنا، لَكانَ خَيْراً لَهُمْ وَأَقْوَمَ﴾ [سورة النساء: ৪৬].
অর্থাৎ: “ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর কথাকে তার জায়গা থেকে বিকৃতি করতে চায়, তারা বলে: আমরা শুনলাম এবং অবাধ্য হলাম, আর শোন না শোনার মতো, আর তাদের জিহŸা বাঁকা করে, দ্বীনের প্রতি আঘাত করে বলে ‘ওয়া রায়িনা’ । আর যদি তারা বলতো: শুনলাম এবং মানলাম, শুনুন এবং আমাদের প্রতি খেয়াল করুন, তাহলে তাদের জন্য কল্যাণ হতো” (সূরা নিসা: ৪৬)।
৩। আবু বকর আল-জাযায়িরী (র.) অত্র আয়াতের তিনটি শিক্ষা উল্লেখ করেছেন:
(ক) ধর্ম ও জ্ঞানের নামে সাধারণ ইহুদীদেরকে বিভ্রান্ত করতে ইহুদী পন্ডিতদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া।
(খ) জেনে-বুঝে আল্লাহর সাথে মিথ্যাচারের দুঃসাহস দেখানো, যা বড় অন্যায়।
(গ) ইহুদীদের বিভ্রান্তিকর আচরণ এবং পার্থিব উদ্দেশ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কলুষিত কথা বলার বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে সতর্ক করা। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়িরী: ১/৩৩৬) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানদের দ্বারা তাওরাত এবং ইনজীল বিকৃত হয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করা।
(খ) ইহুদী-খৃষ্টানদের সকল ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকা।

Leave a Reply

error: Content is protected !!