﴿وَمِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِقِنْطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لَا يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلَّا مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَائِمًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (75) بَلَى مَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ وَاتَّقَى فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ (76) إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا أُولَئِكَ لَا خَلَاقَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (77)﴾ [سورة آل عمران: 75-77]
আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:
আমানত ফেরত প্রদান ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার গুরুত্ব এবং এ বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানের চরিত্র।
আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭৫। আর ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে কিছু লোক আছে, যাদের কাছে যদি অঢেল সম্পদ আমানত রাখো, তবুও সে তা তোমার নিকট আদায় করে দিবে; তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যাদের কাছে যদি আমানত রাখো একটি দীনার, তবে তার পিছনে লেগে না থাকলে সে তা তোমাকে আদায় করবে না; এটি এ কারণে যে, তারা বলে থাকে: আমাদের উপর উম্মীদের ব্যাপারে কোন পাপ নেই; আর তারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে, অথচ তারা জানে।
৭৬। হ্যাঁ, যে তার প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ মোত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন ।
৭৭। নিশ্চয় যারা আল্লাহর অঙ্গীকার এবং তাদের শপথের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য ক্রয় করে, পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আর আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইহুদীদের একটি দল এতই আমানতদার যে, তাদের কাছে কেউ যদি অঢেল সম্পত্তিও আমানত রাখে, তাহলে তারা তা মালিকের কাছে অনায়াসে ফেরত প্রদান করে। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনু সালামের কাছে কোরাইশ বংশের এক ব্যক্তি এক হাজার দুই শত আওকিয়া আমানত রাখলে তিনি তা যথসময়ে ফেরত দিয়েছিলেন। অপরদিকে তাদের মধ্যে আরেকটি দল রয়েছে যাদের কাছে কেউ সামান্য সম্পদ আমানত রাখলেও তারা তা মালিকের কাছে ফেরত দিতে গড়িমসি করে থাকে। এ আমানত ফেরত পাওয়ার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে বাধ্য করা না হলে তারা তা ফেরত না দিয়ে বলে থাকে: মুশরিকদের সম্পদ ফেরত দেওয়া জরুরী না, তাওরাত গ্রন্থে তা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। যেমন: কা’ব বিন আশরাফের কাছে কোরাইশ বংশের এক ব্যক্তি একটি মাত্র দীনার আমানত রাখলে সে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ খেয়ানতী মনোভাবের জবাবে বলেন: তাদের জন্য কারো আমানতের খেয়ানত করাকে হালাল করা হয়নি, বরং তারা জেনে বুঝে মিথ্যাচার করছে। বরং তাওরাতের বিধান হলো: যে কেউ তাদের কাছে কোন কিছু আমানত রাখলে তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া তাদের প্রতি ওয়াজিব। যারা এ বিধান মেনে চলবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ভালোবাসবেন।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা যারা তাঁর সাথে গৃহীত অঙ্গীকারের ভঙ্গকারী এবং আমানতের খেয়ানতকারীর জন্য পাঁচটি শাস্তি বর্ণনা করেছেন:
(ক) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ থাকবে না।
(খ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না।
(গ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না।
(ঘ) আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিচ্ছন্ন করবেন না।
(ঙ) তাদের জন্য আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩৪-৩৩৫, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬৬-২৬৮, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭-৯৮) ।
আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿بِقِنْطَارٍ﴾ “অঢেল সম্পদ”, ‘ক্বিনতার’ শব্দটি আরবী, যা অনেক পরিমাণ বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। (তাফসীর সা’দী: ১/১৩৫) ।
﴿بِدِينَارٍ﴾ “সামান্য সম্পদ”, ‘দীনার’ শব্দটি দ্বারা ক্ষুদ্রাংশের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
﴿الْأُمِّيِّينَ﴾ “নিরক্ষর”, এখানে আয়াতাংশ দ্বারা আরব অথবা কোরাইশদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
﴿سَبِيلٌ﴾ “পথ”, তবে এখানে আয়াতাংশ দ্বারা ‘গুনাহ’ কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৮৮) ।
(৭৭) আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র.) বর্ণনা করেছেন যে, আশয়াচ (রা.) বলেন: আমার এবং এক ইহুদী ব্যক্তির যৌথ এক টুকরা ভ‚মি ছিল। আমি আমার অংশ চাইলে সে তা দিতে অস্বীকার করে। অতঃপর আমি বিষয়টিকে রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে পেশ করলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি ভ‚মির মালিক হওয়ার স্বপক্ষে কোন দলীল আছে? আমি উত্তরে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার কাছে কোন প্রমাণপত্র নেই। তখন তিনি ইহুদী ব্যক্তিকে যমীনের মালিক হওয়া মর্মে শপথ করতে বললেন। তখন আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সা.), তা হলে তো সে মিথ্যা শপথ করে ভ‚মির মালিক হয়ে যাবে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে ইহুদী ব্যক্তিকে সতর্ক করে দিলেন যে, কোন অবস্থাতেই মিথ্যা শপথ করা যাবে না।
ইমাম বুখারী (র.) বর্ণনা করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আবি আওফা (রা.) বলেন: এক ইহুদী বিক্রেতা মুসলমান ক্রেতাদেরকে ধোকা দেওয়ার জন্য পণ্যের গুণাগুণ অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করতো। আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াত অবতীর্ণ করে তাকে সতর্ক করে দিলেন।
ইবনু হাযার আসকালানী (র.) বলেন: উল্লেখিত দুই হাদীসের মধ্যে কোন অসামঞ্জস্যতা নেই, বরং এখানে আয়াতটি অবতীর্ণের দুইটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম তবারী (র.) ইকরামাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আয়াতটি হুয়াই ইবনু আখতাব, কা’ব বিন আশরাফ এবং অন্যান্য ইহুদী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা তাওরাতের বিধানকে গোপন রেখে মনগড়া বানানো বিধানকে সাধারণ মানুষের কাছে উল্লেখ করে আল্লাহর শপথ করে বলতো এ বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। (লুবাব আন-নুকুল, সুয়ূতী: ৬৫) ।
পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে আক্বীদা সম্পৃক্ত বিষয়ে ইহুদী-খৃষ্টানদের নিজেদের অবস্থান এবং মুমিনদেরকে ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতে মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। (আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পঁচাত্তর নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, ইহুদী-খৃষ্টানদের মধ্যে আমানতদার এবং খেয়ানতকারী, দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। তবে এরা কারা? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে তিনটি মত পাওয়া যায়:
(ক) ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা আমানতদার এবং যারা ইহুদী ধর্মে রয়ে গেছে, তারা খেয়ানতকারী।
(খ) খৃষ্টানরা আমানতদার এবং ইহুদীরা খেয়ানতকারী।
(খ) আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম আমানতদার এবং ফিনহাস ইবনু আজুরা খেয়ানতকারী। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, আল-রাযী: ৮/২৬২) ।
২। পচাত্তর নাম্বার আয়াতের তাফসীরে ইমাম তবারী (র.) বলেন: ইহুদী-খৃষ্টানদের কাছে আমানত রাখা হলে তারা স্বাভাবিক ভাবে তা ফেরত দিতো, কিন্তু আমনতকারী যদি ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যেত, তাহলে তার কাছে আমনত ফেরত দিতে অস্বীকার করে বলতো: তাদের আমানত ফেরত না দিলে গুনাহ হবে না। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৫২৩)।
৩। (৭৬-৭৭) নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা আল্লাহ তায়ালার সাথে প্রদত্ত ওয়াদা পূর্ণ করবে অর্থাৎ: আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধকে মান্য করবে ও রাসূলুল্লাহকে (সা.) রাসূল হিসেবে মেনে নিবে এবং মানুষের সাথে কৃত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করবে তাদের পুরস্কার হলো: আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা। অপরদিকে যারা অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করবে, তাদের জন্য পাঁচটি শাস্তি রয়েছে:
(ক) তাদের জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই।
(খ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না।
(গ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে তাকাবেন না।
(ঘ) কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পবিত্র করবেন না।
(ঙ) তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
আয়াতাবলীর আমল:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানদের সবাইকে এক ওজনে পরিমাপ না করা।
(খ) আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য করা।
(গ) মানুষের সাথে প্রদত্ত অঙ্গীকারকে পূর্ণ করা।