﴿وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آمِنُوا بِالَّذِي أُنْزِلَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ وَاكْفُرُوا آخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ (72) وَلَا تُؤْمِنُوا إِلَّا لِمَنْ تَبِعَ دِينَكُمْ قُلْ إِنَّ الْهُدَى هُدَى اللَّهِ أَنْ يُؤْتَى أَحَدٌ مِثْلَ مَا أُوتِيتُمْ أَوْ يُحَاجُّوكُمْ عِنْدَ رَبِّكُمْ قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (73) يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (74)﴾ [سورة آل عمران: 72-74].
আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: আহলে কিতাব কর্তৃক দ্বীনকে নিয়ে তামাশা ও আল্লাহর জবাব।
আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৭২। আহলে কিতাবের আরেকটি দল বলে: তোমরা দিনের প্রথম ভাগে তার প্রতি ঈমান গ্রহণ করো, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে মুমিনদের উপর; এবং দিনের শেষ ভাগে তার প্রতি কুফরী করো, হয়তো তারা ফিরে আসবে।
৭৩। আর তোমরা কেবল তাদেরকে বিশ্বাস করো, যারা তোমাদের দ্বীনের অনুসরণ করে; বলো: নিশ্চয় আল্লাহর হেদায়েত হলো একমাত্র হেদায়েত; (তোমরা এ কথাও বিশ্বাস করো না যে) দেওয়া হবে কাউকে তার অনুরুপ যা তোমাদেরকে (ইতঃপূর্বে) দেওয়া হয়েছে, অথবা তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করবে তোমাদের রবের নিকট; বলো: নিশ্চয় সকল অনুগ্রহ আল্লাহর হাতে, তা দান করেন তিনি যাকে চান; আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
৭৪। তাঁর মহমতের সাথে যাকে ইচ্ছা খাস করে নেন; আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।
আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে ইহুদীদের তৃতীয় আরেকটি চক্রান্ত হলো- তারা নিজেদের ভিতর আপোস করে নিয়েছিল যে, তারা সকালে মুমিন হয়ে আবার সন্ধায় কাফির হয়ে যাবে। এ থেকে মুসলিমদের অন্তরেও নিজেদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যাবে। তারা ভাববে এরা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেছে, অতএব হতে পারে ইসলামে এমন বহু দোষ-ত্রæটি রয়েছে, যা তারা জানতে পেরে এ ধর্ম ত্যাগ করেছে।
তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে বলতো: তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্ভীদেরকে বিশ্বাস করো না। আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবে বলেছেন: তোমাদের ছলনা ও প্রতারণায় কিছু হবে না; কারণ হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিবেন তোমাদের প্রতারণা তাকে হেদায়েত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে আরো বলতো: তোমরা এ কথা মনে কর না যেই দ্বীন-শরীয়ত এবং জ্ঞান-মর্যাদা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্য কেউ লাভ করতে পারে; অথবা তোমরা ছাড়া অন্য কেউ সত্যের উপর থাকতে পারে, যা দিয়ে আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করে তোমাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত কথার জবাবে বলেন: তাদের জেনে রাখা উচিৎ দ্বীন ও শরীয়ত হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। এটা কারো উত্তরাধিকার সূত্রে লদ্ধ জিনিস নয়, বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করেন, আর এ অনুগ্রহ কাকে দেওয়া উচিৎ, তাও তিনি ভালো জানেন। তিনি হলেন মহা অনুগ্রহশীল। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩২, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৭) ।
আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿وَجْهَ النَّهَارِ﴾ “দিনের সম্মুখভাগ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সকাল। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৯৫/ তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৭২) ।
﴿آخِرَهُ﴾ “দিনের শেষের ভাগ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- বিকাল। (গরীব আল-কোরআন, ইবনু কুতাইবা: ৯৫/ তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৭২) ।
(৭১-৭৩) আয়াতদ্বয় অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু সাইফ, আদী ইবনু যায়েদ এবং হারিস ইবনু আউফ নামক ইহুদীরা একে অপরকে বলতো: এসো আমরা সকালে মোহাম্মদের উপর অবতীর্ণ হওয়া কিতাবের প্রতি ঈমান আনি এবং বিকালে তা ত্যাগ করি। এতে তাদের দ্বীন সম্পর্কে তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হবে। ফলে, এক পর্যায় তারা তাদের দ্বীন থেকে ফিরে আসবে। তাদের এ চক্রান্তের জবাবে আল্লাহ তায়ালা (৭১-৭৩) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করেন। (লুবাব আল-নুক‚ল ফি আসাবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৫১) ।
পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে হক্ব থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে ইহুদী-খৃষ্টানদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে, আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মুমিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। (৭২-৭৩) আয়াতদ্বয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইহুদী-খৃষ্টানদের তিনটি চক্রান্ত উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) নিজেদেরকে ঈমানদার দাবী করে মুমিনদেরকে ধোকা দেওয়া, তারা নিজেদের ভিতর আপোস করে নিয়েছিল যে, তারা সকালে মুমিন হয়ে আবার সন্ধায় কাফির হয়ে যাবে। এ থেকে মুসলিমদের অন্তরেও নিজেদের ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যাবে। ফলে, তারা ভাববে এরা ইসলাম গ্রহণ করার পর পুনরায় তাদের ধর্মে ফিরে গেছে, অতএব হতে পারে ইসলামে এমন বহু দোষ-ত্রæটি রয়েছে, যা তারা জানতে পেরে এ ধর্ম ত্যাগ করেছে।
(খ) নিজেদেরকে ছাড়া অন্য ধর্মের কোন অনুসারীকে বিশ্বাস না করা, তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে বলতো: তোমরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কোন ধর্মাবলম্ভীদেরকে বিশ্বাস করো না। আল্লাহ তায়ালা তাদের জবাবে বলেছেন: তোমাদের ছলনা ও প্রতারণায় কিছু হবে না; কারণ হেদায়েত তো আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিবেন তোমাদের প্রতারণা তাকে হেদায়েত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।
(গ) কেবল নিজেদেরকেই হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে দাবী করা, তারা নিজেদের মধ্যে আপোস করে একে অপরকে আরো বলতো: তোমরা এ কথা মনে কর না যেই দ্বীন-শরীয়ত এবং জ্ঞান-মর্যাদা তোমরা লাভ করেছো, তা অন্য কেউ লাভ করতে পারে; অথবা তোমরা ছাড়া অন্য কেউ সত্যের উপর থাকতে পারে, যা দিয়ে আল্লাহর সামনে দলীল পেশ করে তোমাদেরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ভ্রান্ত কথার জবাবে বলেন: তাদের জেনে রাখা উচিৎ দ্বীন ও শরীয়ত হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। এটা কারো উত্তরাধিকার সূত্রে লদ্ধ জিনিস নয়, বরং তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করেন, আর এ অনুগ্রহ কাকে দেওয়া উচিৎ, তাও তিনি ভালো জানেন। তিনি হলেন মহা অনুগ্রহশীল। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০-২৬১) ।
২। উল্লেখিত আয়াতাবলীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ধোঁকাবাজি, একগুঁয়েমি এবং অন্যকে বিভ্রান্ত করার হীনতম চরিত্রের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৩) ।
৩। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইহুদীরা মুসলমানদের কোন ধর্মীয় বিষয়কে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। যুগ যুগ ধরে তাদের বংশীয় চরিত্রকে তারা ধারণ করে আসছে। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩৩৩) ।
৪। (৭৩-৭৪) আয়াতদ্বয় থেকে পরিলক্ষিত হয় যে, হেদায়েত এবং কারো উপর দয়ার একক মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা এ দুইটি নেয়ামতের জন্য নির্ধারণ করে থাকেন। (আল্লাহই ভালো জানেন)
আয়াতাবলীর আমল:
(ক) অন্যকে বিভ্রান্ত অথবা কোন ধরণের ক্ষতি করার জন্য চক্রান্ত না করা।
(খ) নিজের মত অথবা দলকে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে মর্মে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ইহুদীদের চরিত্র।
(গ) হেদায়েত কেবল আল্লাহ তায়ালার কাছে কামনা করা।