Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের (৬৯-৭১) আয়াতাবলীর তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: কিছু আহলে কিতাবের দ্বারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ কর্তৃক জবাব।

﴿وَدَّتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ (69) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ (70) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَلْبِسُونَ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (71)﴾ [سورة آل عمران: 69-71].

 

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:

কিছু আহলে কিতাবের দ্বারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এবং আল্লাহ কর্তৃক জবাব।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৬৯। আহলে কিতাবের মধ্য থেকে একটি দল কামনা করে, যদি তারা তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারতো! কিন্তু তারা বিভ্রান্ত করছে কেবল নিজেদেরকেই, অথচ তারা অনুভব করে না।
৭০। হে আহলে কিতাব! আল্লাহর আয়াতাবলীকে কেন অস্বীকার করছো? অথচ তোমরাই তার সাক্ষ্য দিচ্ছো।
৭১। হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করছো এবং সত্যকে গোপন করছো, অথচ তোমরা অবগত আছো।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ইহুদী-খৃষ্টানদের একটি দল সর্বদা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকানোর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করতে চায়। আল্লাহ তায়ালা তিনটি পদ্ধতিতে তাদের এ হীন আচরণের জবাব দিয়েছেন:
প্রথমত: ঘৃণ্য আচরণের পরিণতি বর্ণনা করার মাধ্যমে, এ কাজের মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করছে। তারা বুঝতে পারছে না যে তাদের এ অপকর্ম মুসলমানদের তো কোন ক্ষতি করতে পারছেই না, বরং এর জন্য তারা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: তাদের চিরাচরিত ঘৃণ্য স্বভাব বর্ণনার মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি কাজ করতো:
(ক) তাওরাত-ইনজীলের যে সকল আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সুসংবাদ এসেছে, তারা কেন সে সকল আয়াতকে অস্বীকার করে? অথচ তারা জানে রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণের সুসংবাদ সত্য।
(খ) তারা কেন তাদের গ্রন্থে বিদ্যমান মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন গুণাবলীকে তাদের বিকৃত মতবাদের সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছে এবং মোহাম্মদ (সা.) এর গুণাবলীকে গোপন রাখার চেষ্টা করছে। অথচ তারা এর হাক্বীকত সম্পর্কে জানেন। (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮-৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿طَائِفَةٌ﴾ “একটি দল”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইহুদী এবং খৃষ্টানদের মধ্যে যারা আহবার-রুহবান বা ওলামা রয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৬৯) ।
﴿وَمَا يُضِلُّونَ﴾ “তারা বিভ্রান্ত করে কেবল নিজেদেরকে”, আয়াতাংশে ইদলাল আরবী শব্দ যার অর্থ হলো: বিভ্রান্ত করা বা পথভ্রষ্ট করা। এর আরেকটি অর্থ হলো: ধ্বংস করা। ইমাম তবারী (র.) বলেন: অত্র আয়াতে শব্দটি দ্বিতীয় অর্থে এসেছে। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৫০০) ।
﴿بِآيَاتِ اللَّهِ﴾ “আল্লাহর আয়াতাবলীর প্রতি”, আয়াতাংশে আল্লাহর আয়াতাবলী দ্বারা ঐ সকল আয়াতাবলীকে বুঝানো হয়েছে যে সকল আয়াতে রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণের সুসংবাদ এবং তার গুণাবলী নিয়ে কথা বলা হয়েছে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২২) ।
﴿الْحَقّ﴾ “সত্য”, আয়াতের দুই জায়গাতেই ‘সত্য’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: রাসূলুল্লাহর (সা.) গুণাবলী, যা তাওরাতে এসেছে। (তাফসীর ইবনু কাছীর: ২/৫৯) ।
﴿بِالْبَاطِلِ﴾ “বাতিলের সাথে”, আয়াতাংশে বাতিল দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: তাহরীফ বা বিকৃতিকরণ। যেহেতু তারা রাসূলুল্লাহর গুণাবলী ও সুসংবাদ সম্বলিত আয়াতাবলীকে বিকৃত করেছিল। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/২৩) ।

(৬৯) নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
মুয়াজ ইবনু জাবাল, আম্মার ইবনু ইয়সির এবং হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে যখন ইহুদীরা তাদের ধর্মের দিকে আহবান করেছিল, তখন তাদের সম্পর্কে উনসত্তর নাম্বার আয়াতঅবতীর্ণ হয়েছে। (আসবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১১১) ।

পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে হক্ব থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে তাদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে, আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে মুমিনদেরকে সত্য পথ থেকে বিপদগামী করার ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। উনসত্তর নাম্বার আয়াতে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ইহুদী-খৃষ্টানরা সর্বদা হিংসার বশবর্তী হয়ে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করতে চায়। যেমন: এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمانِكُمْ كُفَّاراً حَسَداً مِنْ عِنْدِ أنْفُسِهِمْ﴾ [سورة البقرة: ১০৯].
অর্থাৎ: “অনেক ইহুদী-খৃষ্টানরা তোমাদের ঈমান গ্রহণের পরেও হিংসার বশবর্তী হয়ে পুণরায় আবার তোমাদেরকে কুফরীর দিকে ফিরিয়ে আনতে চায়” (সূরা বাক্বারা: ১০৯) ।
(খ) ইহুদী-খৃষ্টানরা শত চেষ্টা করেও মুসলমানদেরকে গোমরাহ করতে পারে নাই, বরং নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৬০) ।
(গ) অন্যকে ক্ষতি করার জন্য গর্ত খনন করলে, অজান্তে সে নিজেই সেই গর্তে পতিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/৩৩০) ।
২। উল্লেখিত তিনটি আয়াতে যারা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢুকানোর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিপথগামী করতে চায়, তিনটি পদ্ধতিতে আল্লাহ তায়ালা তাদের এ হীন আচরণের জবাব দিয়েছেন:
প্রথমত: ঘৃণ্য আচরণের পরিণতি বর্ণনা করার মাধ্যমে, এ কাজের মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করছে।
দ্বিতীয়ত: তাদের চিরাচরিত ঘৃণ্য স্বভাব বর্ণনা পূর্বক তিরস্কার করার মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি কাজ করে থাকে:
(ক) তাওরাত-ইনজীলের যে সকল আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে সুসংবাদ এসেছে, তারা জেনে বুঝে সে সকল আয়াতকে কেন অস্বীকার করে থাকে?
(খ) তারা তাদের গ্রন্থে বিদ্যমান মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বিভিন্ন গুণাবলীকে তাদের বিকৃত মতবাদের সাথে কেন মিশ্রিত করে ফেলে এবং তা গোপন রাখার চেষ্টা করে কেন? (আইসার আল-তাফসীর: ১/৩৩০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৮-৫৯, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৬) । সুতরাং মুসলমানগণ যেন তাদের বিভ্রান্তিমূলক আচরণে বিব্রতবোধ না করে।
৩। সত্তর নাম্বার আয়াতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবী হওয়ার সত্যতার প্রমাণ রয়েছে; কারণ তাওরাতে তার আগমণের সুসংবাদ থাকার বিষয়ে তিনি সংবাদ দিয়েছেন। অথচ তিনি লেখাপড়া জানতেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে এ বিষয়ে সংবাদ না দিলে তিনি তা জানতে পারতেন না। সুতরাং বুঝা যায় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন নবী ও রাসূল। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৫৬) ।
৪। একাত্তর নাম্বার আয়াতে ইহুদী আলেমদের সাধারণ মানুষের সাথে তামাশাপূর্বক তাওরাতের বাণীকে গোপন রাখার মাধ্যমে তা বিকৃতি করার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তারা যতগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করে তাওরাতকে বিকৃতি করেছিল তার অন্যতম হলো: (ক) তাওরাতের বিধানকে তাদের মনগড়া ও সুবিধানুযায়ী কিছু বিধানের সাথে মিশ্রণ করা এবং (খ) তাওরাতে মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমণ সম্পর্কিত কথাগুলো গোপন রাখা।
একজন আলেমের দায়িত্ব হলো আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাবে যা বলেছেন তা কোন ধরণের পরিবর্তন-পরিবর্ধন, মিশ্রন এবং গোপন করা ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা বাতিলকে সত্য থেকে, হারামকে হালাল থেকে এবং অপবিত্রতাকে পবিত্রতা থেকে পার্থক্য করতে পারে। অন্যথায় মানুষের বিশাল অংশ আল্লাহ প্রদত্ব অহীর জ্ঞান তথা হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে। (তাফসীর সা’দী: ১৩৪) ।
৫। ইহুদী-খৃষ্টানরা দুইটি কাজ করতো এবং এখনও করে: (ক) তারা মোহাম্মদকে (সা.) নবী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং (খ) তারা মোহাম্মদের (সা.) নবী হওয়া ও ইসলামের মৌলিক বিষয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাতে সন্দেহ প্রবেশ করিয়ে থাকে। সত্তর নাম্বার আয়াতে তাদের প্রথম স্বভাব থেকে এবং একাত্তর নাম্বার আয়াতে দ্বিতীয় স্বভাব থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২৫৬) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) অন্যকে বিভ্রান্ত অথবা কোন ধরণের ক্ষতি না করা।
(খ) রাসূলুল্লাহকে (সা.) নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নেওয়া।
(গ) আলেম সর্বদা কোরআন-সুন্নাহের বাণী কোন ধরণের অপব্যাখ্যা ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিবে।

Leave a Reply

error: Content is protected !!