Skip to main content

সূরা আলে-ইমরানের (৫২-৫৮) আয়াতের তাফসীর, আলোচ্যবিষয়: ঈসা (আ.) এর সাথে তার কওমের ঘটনা।

﴿فَلَمَّا أَحَسَّ عِيسَى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللَّهِ آمَنَّا بِاللَّهِ وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ (52) رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنْزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ (53) وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ (54) إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (55) فَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (56) وَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (57) ذَلِكَ نَتْلُوهُ عَلَيْكَ مِنَ الْآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ (58)﴾ [سورة آل عمران:52-58].

আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: ঈসা (আ.) এর সাথে তার কওমের ঘটনা।

আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৫২। অতঃপর যখন ঈসা তার কওমের পক্ষ থেকে কুফরী উপলব্ধি করলো, তখন সে বললো: কারা হবে আমার সাহায্যকারী আল্লাহর পথে? হাওয়ারীগণ উত্তর দিলো: আমরাই হবো আল্লাহর সাহায্যকারী, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আর তুমি সাক্ষী থাকো যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।
৫৩। হে আমাদের রব! আমরা ঈমান আনয়ন করেছি তার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন এবং অনুসরণ করেছি রাসূলের, অতএব আমাদেরকে তালিকাভুক্ত করুন সাক্ষ্যদাতাদের।
৫৪। আর তারা কুটকৌশল করেছে এবং আল্লাহ কৌশল করেছেন, আর আল্লাহ হলেন উত্তম কৌশলী।
৫৫। (স্মরণ করো) যখন আল্লাহ বললেন: হে ঈসা! নিশ্চয় আমি তোমার নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ করবো, তোমাকে আমার কাছে উঠিয়ে নিবো এবং তোমাকে পবিত্র করবো কাফেরদের থেকে। আর আমি কিয়ামত পর্যন্ত তোমার অনুসারীদেরকে কাফিরদের উপর সম্মানিত করবো, অতঃপর আমারই দিকে তোমাদের পত্যাবর্তন হবে। তখন আমি তোমাদের মধ্যে মিমাংসা করবো যে বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।
৫৬। অতঃপর যারা কুফরী করেছে, তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন আযাব দিবো, এবং তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না ।
৫৭। আর যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং সৎআমল করেছে তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে তাদের প্রতিদান দিবেন । আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না ।
৫৮। যা আমি তোমার কাছে তেলাওয়াত করছি, তা হলো: আয়াত এবং হিকমতপূর্ণ উপদেশ।

আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
ঈসা (আ.) দাওয়াতী কাজে বের হয়ে তার প্রতি ইহুদী সম্প্রদায়ের অস্বীকৃতি এবং তাকে হত্যার বিষয়ে আঁচ করতে পেরে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন তাদের মধ্যে কারা আছে এ বিপদ মুহুর্তে আল্লাহর পথে তার সাহায্যকারী হবে? তখন তার বিশ্বস্ত সহচরবৃন্দ তার ডাকে সারা দিয়ে আল্লাহর পথে সাহায্যকারী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তারা আরো ঘোষণা করেছিলেন: “আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, আর আপনি সাক্ষী থাকুন আল্লাহর একাত্ববাদ ও অনুসরণকে মেনে নিয়েই আমরা মুসলিম হয়েছি”।
হাওয়ারীগণ তাদের মুসলিম হওয়ার বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা দিলেন: “হে আমাদের রব! আমরা ইনজীলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং ঈসাকে (আ.) রাসূল হিসেবে অনুসরণ করব মর্মে ওয়াদা করেছি। অতএব আপনি ঈসা (আ.) এর তাবলীগের মিশন যথার্থভাবে পালন করা এবং ইহুদী সম্প্রদায় কর্তৃক তাকে অস্বীকার করার ব্যাপারে আমাদেরকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করুন, যেমনিভাবে উম্মতে মোহাম্মাদীকে তাদের নবীর দাওয়াতী কাজের পূর্ণতা এবং কাফেরদের অস্বীকৃতির ব্যাপারে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করবেন”।
আর যারা ঈসাকে (আ.) অস্বীকার করেছিল, তারা তাকে জোরপূর্বক ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার জন্য একজনকে নিয়োগ করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা হত্যার কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ঈসার (আ.) আকৃতি দান করে প্রকৃত ঈসাকে আকাশে তুলে নিলেন আর কাফিররা তাকে ‘ঈসা’ ভেবে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই তাদের ষড়যন্ত্রের জবাবে কৌশল অবলম্ভন করেছিলেন। আর আল্লাহ তায়ালাই কারো ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য উত্তম কৌশলী।
সেদিন যারা ঈসাকে (আ.) হত্যার জন্য উম্মাদ হয়ে উঠেছিল, তাদের ও ঈসার (আ.) মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার হাক্বীকাত বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা তার হাবীব মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে তা পেশ করেন। হাত্যাকারীদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি তাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে সুরক্ষা দিয়ে দুনিয়ায় তার বয়সকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তাকে আকাশে তুলে নিবেন এবং ঈমানদারদেরকে (যারা তাকে অনুসরণ করবে এবং মোহাম্মদ সম্পর্কে তিনি যে সুসংবাদ দিয়েছেন তা মেনে নিয়ে তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে) কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপর বিজয়ী দান করবেন। অতঃপর তাদের সবাইকে হাশরের ময়দানে একত্র করে ‘ঈসা’ এর সাথে কেমন আচরণ করেছিলো তার বিচার করা হবে।
সুতরাং ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা তাকে অস্বীকার করবে এবং খৃষ্টানদের মধ্য থেকে যারা তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে তাদেরকে দুনিয়ায় হত্যা করে, সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে ও ক্ষমতাচ্যুত করে শাস্তি দেওয়া হবে এবং আখেরাতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ আযাব থেকে রক্ষা করার মতো কোন সাহায্যকারী থাকবে না।
অপরদিকে যারা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং সৎআমল করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দান করবেন। আর যারা শিরক ও কুফরের মাধ্যমে নিজেদের উপর যুলম করে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পছন্দ করেন না। আর যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, মারইয়াম এবং ঈসা (আ.) এর কাহিনী, যা আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে পাঠ করে শুনাচ্ছেন, তা হলো আয়াত এবং হিকমাতপূর্ণ উপদেশ। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৬৮, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩২২-৩২৩, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৬-৫৭, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৩-৯৪) ।

আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿أَحَسَّ﴾ “সে অনুভব করেছে”, আয়াতাংশের অর্থ হলো: ‘সে জানতে পেরেছে’ অথবা ‘সে পেয়েছে’। কারণ, যখন কেউ কিছু জানতে পারে অথবা কিছু পেয়ে থাকে. তখন আরবরা বলে থাকেন: ‘হাল আহসাসতা’ বা তুমি কি অনুভব করেছো?। (মায়ানী আল-কোরআন, যুজাজ: ১/৪১৬) ।
﴿الْكُفْرَ﴾ “কুফরি”, আয়াতাংশ দ্বারা ঈসা (আ.) এর প্রতি ইহুদীদের অস্বীকৃতি, ইনজীলের বিধানের সাথে বিরুদ্ধাচরণ এবং তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকে একত্রে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৫২) ।
﴿إِلَى اللَّهِ﴾ “আল্লাহর দিকে”, আয়াতাংশের অর্থ হলো:
(ক) ‘আল্লাহর সাথে’, ‘ইলা’ বা দিকে যখন ‘গাইয়াহ’ বা প্রান্ত অর্থে না আসে, তখন আরবরা তা ‘মা’য়া’ বা সাথে অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। (মায়ানী আল-কোরআন, ফাররা: ১/২১৮)। তখন আয়াতের অর্থ হবে: আল্লাহর সাথে আমার সাহায্যকারী কে আছো?
(খ) ‘আল্লাহর পথের দিকে’, এখানে আল্লাহ শব্দের পূর্বে ‘সাবীল’ বা পথ সম্বন্ধ পদটি উহ্য রয়েছে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৯৭, তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩৭) । তখন আয়াতের অর্থ হবে: আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী আছো?
﴿الْحَوَارِيُّونَ﴾ ‘আল-হাওয়ারিয়্যূন’, আয়াতাংশে ‘হাওয়ারিয়্যূন’ শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো সাধা। এর দ্বারা ঈসা (আ.) এর ১২ জন সহচরকে বুঝানো হয়েছে। তাদেরকে ‘হাওয়ারিয়্যূন’ বলার কারণ কি? এ বিষয়ে তাফসীরকারকগণ বলেন:
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: তারা সাধা পোষাক পড়তেন, এজন্য তাদেরকে ‘হাওয়ারিয়্যূন’ বলা হতো। আর তারা পেশায় শিকারী ছিলেন।
(খ) মারইয়াম (আ.) তার ছেলে ঈসাকে (আ.) অনেক কাজ শিক্ষা দিয়েছেন। অবশেষে তিনি তাকে কাপড় রঙ করানোর কাজ শিখানোর জন্য হাওয়ারী রঞ্জকদের কাছে পাঠালেন। ঈসার (আ.) শিক্ষক সফর করতে চেয়েছিলেন। অতঃপর তিনি তাকে বললেন: আমার কাছে বিভিন্ন রঙের কাপড় রয়েছে, আমি যে তোমাকে রঙ করা শিখিয়েছি, তদানুযায়ী এ পোষাকগুলো রঙ করে দাও। ঈসা (আ.) একটি দানা রান্না করে তাতে সব পোষাক ঢেলে দিয়ে বললেন: আমি যেভাবে রং করতে চাই আল্লাহর ইচ্ছায় সেভাবে হয়ে যাও। অতঃপর হাওয়ারী শিক্ষক এসে তার এ অবস্থা দেখে বললেন: তুমি তো সব কাপড় নষ্ট করে ফেলেছো। জবাবে ঈসা (আ.) সব কাপড়গুলো লাল, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি রঙে বের করে আনলেন। এতে শিক্ষক আশ্চর্য হয়ে জানতে পারলেন এটা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে এবং তিনি তাঁর দিকেই মানুষকে আহবান করেন। অতঃপর তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরাই হলেন ‘হাওয়ারিয়্যূন’। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৯৮) ।
(গ) ঈসা (আ.) গমণ পথে একদল জেলেকে মাছ শীকার করতে দেখে বললেন: আসো আমরা মানুষ শীকার করি। তিনি নিজেকে তাদের কাছে আল্লাহর রাসূল হিসেবে পরিচয় দিলে তারা মুজিযা দেখতে চায়। অতঃপর তিনি মুজিযা দেখালে তাদের সকলে ঈমান গ্রহণ করেন। তাদেরকে ‘হাওয়ায়ি্যূন’ বলা হয়। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ৮/২৩৪) ।
﴿الشَّاهِدِينَ﴾ “সাক্ষীগণ”, আয়াতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: উম্মতে মোহাম্মাদী, যারা তাদের নবীর দাওয়াতী কাজের পূর্ণতা এবং কাফেরদের অস্বীকৃতির ব্যাপারে কিয়ামতের দিন সাক্ষী হবেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭) । সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: ঐ সকল সাক্ষীদের সাথে আমাদেরকেও ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করুন।
﴿إِنِّي مُتَوَفِّيكَ﴾ “নিশ্চয় আমি তোমার নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ করব”, আয়াতাংশে নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ করা দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের অভিমত নিম্নে:
(ক) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) জাগ্রতাবস্থায় আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং শেষ যমানায় তাকে পুনরায় মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পৃথিবী সংস্কারের উদ্দেশ্যে পাঠাবেন।
(খ) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) ঘুম পড়িয়ে আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং শেষ যমানায় মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পৃথিবী সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করবেন।
(গ) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) মৃত্যুর মাধ্যমে আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং শেষ যমানায় তাকে পুনরায় জীবিত করে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হিসেবে পৃথিবী সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করবেন।
তবে দ্বিতীয় মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য; কারণ পৃথিবী থেকে আকাশের এ বিশাল দুরত্ব পাড়ি দেওয়া একজন জাগ্রত মানুষের জন্য যেমন ভয়াবহ, তেমনিভাবে পথে এমন কিছু ভয়াবহ বিষয় রয়েছে, যা অবলোকন করা তার দৃষ্টি শক্তির ক্ষমতার বাহিরে।
প্রথম মতটি দ্বিতীয় মতের নিকটবর্তী। আর তৃতীয় মতটি দুই কারণে দূর্বল:
(ক) সূরা নিসা এর ১৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে: ঈসার (আ.) মৃত্যুর পূর্বে সকল আহলে কিতাব তার প্রতি ঈমান গ্রহণ করবে। এ আয়াত থেকে বুঝা যায় তিনি মৃত্যুবরণ করেননি।
(খ) আল্লাহ তায়ালার সুন্নাত বা সাধারণ নিয়ম হলো তিনি কাউকে মৃত্যুর পরে জীবিত করেন না, ঈসা (আ.) এর ক্ষেত্রেও তার বিপরীত নয়। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৫৫) ।
﴿رَافِعُكَ إِلَيَّ﴾ “তোমাকে আমার দিকে উত্তোলনকারী”, সকল তাফসীরকারক একমত যে আয়াতাংশে ‘আমার দিকে’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আকাশে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/১৯) ।
﴿مُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا﴾ ‘তোমাকে কাফেরদের থেকে পবিত্রকারী’, আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) কি থেকে পবিত্র করবেন? এ ব্যাপারে অধিকাংশ তাফসীরকারকদের অভিমত হলো: তার মায়ের ব্যাপারে কাফেরদের মিথ্যা অপবাদ থেকে তাকে পবিত্র করবেন। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩৮) ।
﴿فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُوا﴾ ‘কাফেরদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব’, আয়াতাংশে দুই দিকের শ্রেষ্ঠত্বকে বুঝানো হয়েছে:
(ক) ঈসার (আ.) অনুসারীগণ মোহাম্মদ (সা.) এর আগমণের পর তার উপর ঈমান গ্রহণ করে তাকে অনুসরণ করলে আল্লাহ তায়াল কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে ঈমান, আক্বীদা ও শরীয়াহ এ শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় রাখবেন। (আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৭) ।
(খ) আল্লাহ তায়ালা বিজয় প্রদানের মাধ্যমে খৃষ্টানদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত ইহুদীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিবেন। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/১৯) ।
﴿فِيمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ﴾ ‘যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করেছিলে’, আয়াতাংশে তাদের মতবিরোধের বিষয়বস্তু কি ছিল? এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের অভিমত নিম্নে:
(ক) ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হওয়ার বিষয়ে তাদের মতবিরোধের ফয়সালা করবেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭) ।
(খ) ঈসাই ধর্মের বিষয়ে তাদের মতবিরোধের ফয়সালা করবেন। (তাফসীর আল-নাসাফী: ২/১৯) ।
পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসা (আ.) এর দশটি বৈশিষ্ট্য এবং চারটি মুযিজা উল্লেখ করার মাধ্যমে তার নবুয়াতকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে দাওয়াতী ময়দানে ঈসা (আ.) এর সাথে তার কওমের ঘটে যাওয়া কাহিনী, তাকে হত্যার পরিকল্পনা, আকাশে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তাকে মুক্তি প্রদান, যারা তাকে অস্বীকার করেছে তাদের পরিণতি এবং যারা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে তাদের পুরস্কারের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং পূর্ববর্তী আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩৮-২৩৯) ।

৫৮ নং আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
হাসান বাসারী (র.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে নাজরান থেকে দুইজন খৃষ্টান পাদ্রী এসে প্রশ্ন করেছিলেন ঈসার (আ.) আব্বার নাম কি? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর প্রদানে তাড়াহুড়া না করে তার রবের পক্ষ থেকে অহীর অপেক্ষা করলে আল্লাহ তায়ালা আটান্ন নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন যে পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসার (আ.) আত্মীয়-স্বজনের কাহিনী, তার মায়ের জন্মের ঘটনা এবং তার নিজের জন্মের ঘটনাই তাদের অযৌক্তিক প্রশ্নের জবাব। (আসবাব আল-নুযূল, সুয়ূতী: ৬২) ।

আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। বায়ান্ন নাম্বার আয়াত থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) আল্লাহর দ্বীনকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন, তারা অবশ্যই অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-যুলম, হত্যা-রক্তাপাতের সম্মুখীন হবেন।
(খ) দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করতে আল্লাহর পথের দায়ীদের এমন কিছু একনিষ্ঠ সহচরের প্রয়োজন হয়, যারা বিপদ মুহুর্তে ঢালের মতো তাদের পাশে থাকবে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৪৩) । যেমন: অত্র আয়াতে ঈসাকে (আ.) দেখতে পাই তিনি তার কওম থেকে একনিষ্ঠ কিছু সহচর অনুসন্ধান করেছিলেন। অনুরুপভাবে রাসূলুল্লাহর (সা.) আনসার ও মুহাজিরদের মধ্য থেকে কিছু একনিষ্ঠ সহচর ছিল। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (সা.) আহযাব যুদ্ধের দিন বলেছেন:
مَنْ يَأْتِينَا بِخَبَرِ الْقَوْمِ؟ فَقَالَ الزُّبَيْرُ: أَنَا، ثُمَّ قَالَ: مَنْ يَأْتِينَا بِخَبَرِ الْقَوْمِ؟ فَقَالَ الزُّبَيْرُ: أَنَا، ثُمَّ قَالَ: مَنْ يَأْتِينَا بِخَبَرِ الْقَوْمِ، فَقَالَ الزُّبَيْرُ: أَنَا، ثُمَّ قَالَ إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوَارِيَّ وَإِنَّ حَوَارِيَّ الزُّبَيْرُ. (متفق عليه، صحيح البخاري: ৪১১৩).
অর্থাৎ: কুরাইশ কাফিরদের খবর আমাদের নিকট কে এনে দিতে পারবে? যুবায়ের (রা.) বললেন: আমি। তিনি আবার বললেন: কুরাইশদের খবর আমাদের নিকট কে এনে দিতে পারবে? তখনও যুবায়ের (রা.) বললেন: আমি। তিনি আবারও বললেন: কুরাইশ কাফিরদের খবর আমাদের নিকট কে এনে দিতে পারবে? এবারও যুবায়ের (রা.) বললেন: আমি। অতঃপর তিনি বললেন: নিশ্চয় প্রত্যেক নবীরই হাওয়ারী বা বিশেষ সাহায্যকারী ছিল। আমার হাওয়ারী হলো: যুবায়ের। (মুত্তাফাকুন আলাইহি, সহীহ আল-বুখারী: ৪১১৩) ।
(গ) যারা আল্লাহর পথের দায়ীদের একনিষ্ঠ সহচর হবে, তারা চাইলে দায়ীদেরকে পরিতুষ্ট করা ও সাক্ষী রাখার উদ্দেশ্যে তাদের ঈমান ও ইসলামের আত্মস্বীকৃতি প্রদান করতে পারবে। যেমন: উল্লেখিত আয়াতের শেষাংশে হাওয়ারীগণ ঈসার (আ.) ডাকে সারা দেওয়ার পর বলেছিলেন: আপনি সাক্ষী থাকেন “নিশ্চয় আমরা মুসলিম”।
২। ৫৩নং আয়াতে সাক্ষীগণ দ্বারা নিম্নের যে কোন একটি অথবা সবগুলো উদ্দেশ্য হতে পারে:
(ক) অধিকাংশ আলেম মনে করেন, মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) এর উম্মতকে বুঝানো হয়েছে।
(খ) যারা নবী-রাসূলদেরকে সত্যবাদী হিসেবে সাক্ষী দিয়েছেন, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৯৮) ।
(গ) যারা আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদের সাক্ষী দিয়েছেন, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৫৮) ।
৩। ৫৪নং আয়াতে দুইটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ঈসা (আ.) তার কওমের কাছে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে গেলে তাকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল, আর আল্লাহ তায়ালা তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
(খ) এখানে বলা হয়েছে: “আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্র করেছেন এবং তিনিই উত্তম ষড়যন্ত্রকারী”। আর ‘ষড়যন্ত্র করা’ ক্রিয়াটি খারাপ অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। তাহলে আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্র করেছেন এর অর্থ কি হতে পারে? এটি একটি আক্বীদা বিষয়ক মাসয়ালা, এ বিষয়ে তাফসীরকারকদের থেকে দুইটি অভিমত পাওয়া যায়:
(ক) একদল তাফসীরকারক মনে করেন, “ষড়যন্ত্র করা” আল্লাহ তায়ালার একটি সিফাত বা গুণ, যা কেবলমাত্র কারো ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় প্রয়োগ হয়ে থাকে। (তাফসীর আল-বায়যাভী: ২/১৯, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭) । এ মতের অনুসারীগণ মনে করেন আল্লাহর কোন সিফাতকে কোন ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিলুপ্তিকরণ, বিকৃতিকরণ এবং সাদৃশ্যকরণ ছাড়া দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করা। এটিই প্রকৃত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস। (শারহ আল-আক্বীদাহ আল-ওয়াসিতিয়্যাহ, খলীল হাররাস: ৬৫) ।
(খ) আরেকদল তাফসীরকারক মনে করেন, “ষড়যন্ত্র করা” শব্দটি আল্লাহর শানে বেমানান হওয়ার কারণে তা এমন একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার হবে, যা আল্লাহর শানে মানানশীল, যেমন: আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রের জন্য শাস্তি দিয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন ইত্যাদি। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৫৮, আল-মোন্তাখাব: ১/৯৩) । এ মতের অনুসারীদেরকে আহলুত তা’ভীল বলা হয়। তারা মনে করেন আল্লাহ তায়ালার সিফাত বা গুণাবলীকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাবে। আশায়েরাহ এবং মাতুরিদিয়্যাহ সম্প্রদায় এ মতকে গ্রহণ করেছেন। (মাওসূআতুল ফিরাক্ব, দুরার আস-সুন্নিয়্যাহ) ।
তবে প্রথম মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য, কারণ সালফে সালিহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, তারিয়ূন এবং তাবে তাবিয়ীনগনের কাছে আল্লাহর সিফাতগুলো যেভাবে বলা হতো তাতে কোন ধরণের জিজ্ঞাসা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া সে ভাবেই তারা বিশ্বাস করতেন। (শারহ আল-আক্বীদাহ আল-ওয়াসিতিয়্যাহ, খলীল হাররাস: ৬১) ।
৪। ৫৫নং আয়াতে ঈসার (আ.) প্রতি আল্লাহ তায়ালার পাঁচটি অনুগ্রহ বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) যখন কাফেররা ঈসাকে (আ.) হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল, তখন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় তার বয়সের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য তাদের সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
(খ) আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) আকাশে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে কাফেরের ষড়যন্ত্র থেকে তাকে সংরক্ষণ করেছেন।
(গ) তার মায়ের ব্যাপারে কাফেরদের মিথ্যা অপবাদ থেকে তাকে পবিত্র করেছেন।
(ঘ) যারা ঈসাকে (আ.) অনুসরণ করবে এবং মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সা.) আগমেণের পর তার প্রতি ঈমান এনে তাকেও অনুসরণ করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কিয়ামত পর্যন্ত ঈমান, আক্বীদা ও শরীয়াহ এ শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় রাখবেন। (আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৭)।
(ঙ) হাশরের ময়দানে সবাইকে জড়ো করে ঈসার (আ.) ব্যাপারে যে মতবিরোধ করেছিল, তার বিচার করা হবে।
৫। ৫৬নং আয়াত থেকে বুঝা যায় ঈসার (আ.) প্রতি আল্লাহ তায়ালার পাঁচটি অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে, তাদের শাস্তির ভয়াবহতা হবে নিম্নরুপ:
(ক) দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে।
(খ) শাস্তির যন্ত্রণা প্রচন্ড আকারের হবে।
(গ) শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে কোন সাহায্যকারী পাবে না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৪০-২৪১) ।
৬। ৫৭নং আয়াত থেকে বুঝা ঈসার (আ.) প্রতি আল্লাহ তায়ালার পাঁচটি অনুগ্রহকে স্বীকার করে সৎআমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পুরুস্কৃত করবেন। এ আয়াত থেকে নিম্নের কয়েকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) ঈমান ও সৎআমল দুইটি আলাদা জিনিস; কারণ এখানে সংযোজন পদ দিয়ে দুইটি ভিন্ন জিনিসকে একত্র করা হয়েছে।
(খ) আখেরাতে মানুষ পুরস্কৃত হবে তার ঈমান ও সৎআমলের কারণে।
(গ) যালেমদের জন্য আল্লাহ তায়ালা কল্যাণসাধন করেন না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৪১-২৪২) ।
৭। ৫৮নং আয়াত থেকে বুঝা যায় যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, মারইয়াম এবং ঈসা (আ.) এর ঘটনা বর্ণনা মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি আল্লাহ তায়ালার অহীর সত্যতার প্রমাণ বহণ করে; কারণ অহী ছাড়া এ সকল ঘটনা জানা রাসূলুল্লাহর (সা.) জন্য সম্ভব ছিল না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৪২) ।

আয়াতাবলীর আমল:
(ক) আল্লাহর পথের দায়ী দাওয়াতী কাজের সহযোগিতার জন্য একান্ত সহচর নির্বাচন করবে।
(খ) একজন অনুসারী তার মুসলিম হওয়ার বিষয়ে তার দ্বীনী অভিভাবকের কাছে স্বীকৃতি দিবে।
(গ) ঈসাকে (আ.) আল্লাহ তায়ালা জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নিয়েছেন এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মাত হয়ে আগমণ করে সমাজ সংশোধন করবেন, এ কথা বিশ্বাস করা।

Leave a Reply

error: Content is protected !!