﴿إِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ (45) وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ (46) قَالَتْ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ قَالَ كَذَلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (47) وَيُعَلِّمُهُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ (48) وَرَسُولًا إِلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ أَنِّي أَخْلُقُ لَكُمْ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنْفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللَّهِ وَأُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ وَأُحْيِ الْمَوْتَى بِإِذْنِ اللَّهِ وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (49) وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُمْ بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ وَجِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ (50) إِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ (51)﴾ [سورة آل عمران: 45-51].
আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়:
ঈসা (আ.) এর জীবনী প্রসঙ্গ তার আগমণের সুসংবাদ এবং আল্লাহ প্রদত্ত দশটি বৈশিষ্ট্য।
আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
৪৫। (স্বরণ করো) যখন ফেরেশতা বললো: হে মরইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হবে মাসীহ ঈসা ইবনু মারইয়াম, যিনি দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবেন।
৪৬। এবং সে কথা বলবে মানুষের সাথে দোলনায় ও পরিণত বয়েসে, আর সে নেক্কারদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
৪৭। মারইয়াম (আ.) বললো: হে আমার রব! কিভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ আমাকে স্পর্শ করেনি কোন মানুষ। তিনি বললেন: এ ভাবে আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়ের, তখন তিনি শুধু তাকে বলেন: হও, ফলে তা হয়ে যায়।
৪৬। এবং তিনি তাকে কিতাব, হিকমাত, তাওরাত এবং ইনজীল শিক্ষা দিবেন ।
৪৯। সে বনী ইসরাঈলের একজন রাসূল হবে; (সে বলবে) নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট এসেছি তোমাদের রবের আয়াত নিয়ে, নিশ্চয় আমি বানাবো তোমাদের জন্য মাটি থেকে পাখির আকৃতি, অতঃপর তাতে ফুঁক দিবো, ফলে তা আল্লাহর হুকুমে একটি পাখি হয়ে যাবে; আমি সুস্থ করবো জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রুগীকে এবং মৃতকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করবো; আর তোমাদেরকে জানিয়ে দিবো যা তোমরা আহার করো এবং যা তোমাদের ঘরসমূহে জমা করে রাখো; নিশ্চয় এতে রয়েছে নিদর্শন তোমাদের জন্য, যদি তোমরা হয়ে থাকো মুমিন।
৫০। এবং (সে বলবে: আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে) সত্যায়নকারীরুপে যা রয়েছে আমার সামনে তাওরাত থেকে; এবং হালাল করতে তোমাদের জন্য কিছু অংশকে যা তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছিল; এবং তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে আয়াত নিয়ে এসেছি; সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাকে অনুসরণ করো।
৫১। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমার রব এবং তোমাদের রব, অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত করো; এটাই সরল পথ।
আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন: যখন জিবরীল (আ.) মারইয়াম (আ.) কে অলৌকিকভাবে পিতা বিহীন মাসীহ ঈসা ইবনু মারইয়াম (আ.) এর সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের কাছে ছিলেন না। আল্লাহ তায়ালা তাকে দশটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন:
(ক) দুনিয়াতে অহী প্রদান এবং আখেরাতে জান্নাত প্রদানের মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হবে।
(খ) আখেরাতে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(গ) দোলনায় থাকাবস্থায় তার মায়ের পবিত্রতা ঘোষণার জন্য শিশুকালে মানুষের সাথে কথা বলবেন ও বৃদ্ধাবস্থায় তাদেরকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিবেন।
(ঘ) কথায় ও কাজে নেক্কার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(ঙ) তিনি পিতা বিহীন মারইয়ামের গর্ভে অলৌকিভাবে সৃষ্টি হয়েছেন, এ অলৌকিক সুসংবাদে আশ্চর্যান্বিত হয়ে মারইয়াম (আ.) বললেন: আমার কিভাবে সন্তান হবে! অথচ আমার স্বামী নেই এবং কোন বেগানা পুরুষ আমাকে কোন দিন স্পর্শ করেনি। অথচ সন্তান হওয়ার জন্য একজন পুরুষের সংস্পর্শে যেতে হয়। তখন জিবরীল (আ.) উত্তর দিলেন: পিতা বিহীন সন্তান দান করা সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মোটেই কঠিন বিষয় নয়, এভাবেই তিনি কোন বিষয় করার সিদ্ধান্ত নিলে, শুধু বলেন হও, ফলে সাথে সাথেই তা হয়ে যায়।
(চ) ঈসাকে (আ.) হস্তলিপি, প্রজ্ঞা, তাওরাত এবং ইনজীল শিক্ষা দিয়েছেন।
(ছ) তিনি বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসূল।
(জ) রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাকে চারটি মুজেযা দান করেছেন, যেমন: মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুঁক দিলে জীবন্ত পাখি হওয়া, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা, আল্লাহর হকুমে মৃতকে জীবিত করা এবং কারো ঘরে যা খাওয়া হয়েছে ও যা জমা রাখা হয়েছে তা সম্পর্কে সংবাদ দিতে পারা।
(ঝ) তিনি তাওরাতের সত্যায়নকারী।
(ঞ) বনী ইসরাঈলের উপর যা হারাম করা হয়েছিল তার মধ্য থেকে কিছু অংশ হালাল করা। অতঃপর ঈসা (আ.) তার বংশধরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: যেই আল্লাহ আমাকে দশটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে তোমাদের কাছে পাঠালেন তোমরা তাকে ভয় করো এবং আমার অনুসরণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা আমার এবং তোমাদের মা’বূদ ও পালনকর্তা, অতএব একমাত্র তারই ইবাদত করো। এটাই সরলসহজ পথ। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৫৭, আইসার আল-তাফসীর: ১/৩১৮-৩২০, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫৫-৫৬, আল-মোন্তাখাব: ১/৯২-৯৩) ।
আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿الْمَلَائِكَةُ﴾ “ফেরেশতাগণ”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: জিবরীল (আ.) । জিবরীল (আ.) এর সম্মানের বিবেচনায় শব্দটি বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে; কারণ তিনি ফেরেশতাদের সরদার ছিলেন। এছাড়াও সূরা মারইয়াম এর ১৭ নাম্বার আয়াতে জিবরীল (আ.) এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/৫৪) ।
﴿بِكَلِمَةٍ مِنْهُ﴾ “তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালেমার”, আয়াতাংশে ‘কালেমা’ আরবী শব্দ, যার অর্থ হলো: শব্দ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ‘কুন’ বা হও, যার দ্বারা ঈসাকে (আ.) বুঝানো হয়েছে; কারণ তাকে আল্লাহ তায়ালা পিতা বিহীন অলৌকিক ক্ষমতাবলে ‘কুন’ কালেমা দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৪৫) ।
﴿الْمَسِيحُ﴾ “আল-মাসীহ”, শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো: স্পর্শকারী। আল্লাহ তায়ালা ঈসাকে (আ.) এ নামে ভ‚ষিত করেছেন। তবে এ নামে ভ‚ষিত করার কারণ কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) তিনি কোন রোগীকে স্পর্শ করলে সে আরোগ্য লাভ করবে।
(খ) তিনি বেশী বেশী ভ্রমণ করার কারণে যমীনের বেশীর ভাগ অংশের সংস্পর্শ পেয়েছেন।
(গ) ‘আল-মাসীহ’ এর আরেকটি অর্থ হলো: সুন্দর। ঈসা (আ.) দেখতে সুন্দর ছিলেন, তাই তাকে ‘আল-মাসীহ’ বলা হয়েছে।
কাওয়ারী (র.) বলেন: প্রথম মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/৪৫) ।
﴿فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا﴾ “দোলনায় এবং বার্ধক্য অবস্থায়”, সকল তাফসীরকারক একমত যে আয়াতাংশে ‘আল-মাহদ’ বা দোলনা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: নবজাতকের প্রথম দুই বছর, যে সময়ে মায়ের বুকের দুধ পান করে থাকে।
আর ‘কাহল’ শব্দটি আরবী, যার অর্থ হলো: যৌবন এবং শক্তির সমন্বয় ঘটা। যখন উদ্ভিদ প্রবল শক্তি দিয়ে গজিয়ে উঠে তখন আরবরা তাকে ‘কাহল’ বলে থাকেন। আয়াতাংশে ‘কাহল’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের থেকে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) মানুষের ৩০ বছর থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত বয়স সীমাকে ‘কাহল’ বলে। (তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১৫৩) ।
(খ) মানুষের ৪০ বছর বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে ‘কাহল’ বলে। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২২৯) ।
(গ) মানুষের যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যবর্তী সময়কে ‘কাহল’ বলে। (আইসার আল-তাফাসীর, জাযায়েরী: ১/৩১৮) ।
(ঘ) হুসাইন ইবনু ফাযল (র.) বলেন: শেষ যমানায় আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়ে ঈসা (আ.) মানুষের সাথে কথা বলবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ‘কাহল’ দ্বারা এ সময়কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৪২০, আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২২৫) ।
তবে তৃতীয় মতটি সঠিক হওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী; কারণ ঈসাকে (আ.) ৩৩ বছর বয়েসে আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছে। এ হিসেবে তিনি আকাশে উঠে যাওয়ার পূর্বে ‘কাহল’ এর বয়স সীমায় উপনীত হননি। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৮/২২৫) ।
﴿الْكِتَابَ﴾ ‘কিতাব’, দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: হস্তলিপি। আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) কে হস্তলিপি শিক্ষা দিয়েছিলেন। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৪২২) ।
﴿الْحِكْمَةَ﴾ ‘হিকমাহ’, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: ইনজীলের বাহিরে ঈসা (আ.) এর বাণী, যা পান্ডুলিপি আকারে লেখা হয়েছে। (তাফসীর আল-তবারী: ৬/৪২২) ।
﴿وَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ﴾ ‘যা তোমরা খেয়ে ফেলো এবং যা তোমাদের ঘরে জমা করে রাখো, সে বিষয়ে আমি সংবাদ দিবো’, আয়াতাংশ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) এর বংশধরদের উপর আসমানি খাবার অতবীর্ণ করতেন, যা ঘরে না জমিয়ে খেয়ে ফেলার নির্দেশ ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার পরে ঘরে জমা করে রাখার চেষ্ট করছিল। এ বিষয়টি তদারকি করার জন্য আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.) কে গায়েব জানার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ফলে, তিনি একজনে কি পরিমাণ খাবার খেয়েছে তা জানার পাশাপাশি কেউ খাবার জমা করে রাখলে তাও তিনি বুঝতে পারতেন। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২২৯) ।
﴿وَلِأُحِلَّ لَكُمْ بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ﴾ ‘কিছু বিষয়, যা হারাম করা হয়েছিল’, আয়াতাংশে হারাম হওয়া বিষয় দ্বারা উদ্দেশ্য কি? এ সম্পর্কে ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র.) থেকে দুইটি উত্তর পাওয়া যায়:
(ক) মূসা (আ.) এর মৃত্যুর পর ইহুদী আহবার বা পন্ডিতগণ তাদের ধর্মের সাথে নিজেদের মনগড়া বানোয়াট বিষয় সংযোগ করে মূসা (আ.) এর দিকে নিসবাত করেছিল। ঈসা (আ.) এসে বানোয়াট বিষয়গুলোকে ধর্ম থেকে দুর করেছিলেন। সুতরাং আয়াতাংশে ইহুদী ধর্মে তাদের পন্ডিতদের বানোয়াট বিষয়গুলোকে বুঝানো হয়েছে।
(খ) ইহুদীদের হটকারিতা এবং অপকর্মের শাস্তি স্বরুপ কিছু হালাল বিষয়কে আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর হারাম করেছিলেন। ঈসা (আ.) এসে উক্ত হারাম বিষয়সমূহকে পুনরায় হালাল করেছিলেন। সুতরাং আয়াতাংশে শাস্তি স্বরুপ ইহুদীদের উপর হারাম হওয়া বিষয়গুলোকে বুঝানো হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৩১) ।
﴿وَجِئْتُكُمْ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ﴾ ‘এবং আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে কিছু আয়াত নিয়ে এসেছি’, আয়াতাংশে ‘কিছু আয়াত’ দ্বারা ঈসা (আ.) এর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ব পাঁচটি মুজিযাকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৪৪০) ।
পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে উল্লেখিত আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
পূর্বের আয়াতাবলীতে ঈসা (আ.) এর নিকটাত্মীয় যাকারিয়্যা (আ.), ইয়াহইয়া (আ.) এবং ঈসা (আ.) এর মা মারইয়াম (আ.) এর ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে। আর উল্লেখিত আয়াতাবলীতে ঈসা (আ.) এর জন্মের কাহিনী বর্ণনা করার মাধ্যমে তার জন্মের প্রকৃত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর, জুহাইলী: ৩/২৩০) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। পঁয়তাল্লিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহর কাছে মারয়াম (আ.) এর মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। যেহেতু ফেরেশতা জিবরীল (আ.) মানুষের আকৃতিতে তার কাছে এসে ঈসা (আ.) এর সুসংবাদ দিয়েছেন (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩১৮) । এ সম্পর্কে সূরা মারয়াম এ বলা হয়েছে:
﴿فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا﴾ [سورة مريم: ১৭).
অর্থাৎ: “আমি তার কাছে জিবরীলকে পাঠালাম, সে পুরোপুরি একজন মানুষের আকৃতিতে তার সামনে আত্মপ্রকাশ করলো” (সূরা মারইয়াম: ১৭) ।
২। সাতচল্লিশ নাম্বার আয়াত থেকে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়:
(ক) অস্পষ্ট কোন বিষয়ের হাক্বীকত বা হেকমাত বুঝার জন্যে ব্যাখ্যা তলব করা জায়েজ আছে। কারণ অত্র আয়াতে দেখতে পাই মারইয়াম (আ.) যখন পুরুষ মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া সন্তান হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারলেন না, তখন তিনি ব্যাখ্যা চেয়েছেন। অনুরুপভাবে অত্র সূরার চল্লিশ নাম্বার আয়াতে যাকারিয়া (আ.) যখন বৃদ্ধ বয়েসে বন্ধা স্ত্রীর গর্ভে সন্তান হওয়ার সুসংবাদের বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন না, তখন তিনি আল্লাহর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। (আইসার আল-তাফাসীর: ১/৩১৮) ।
(খ) ঈসা (আ.) এর আগমণের সুসংবাদকে ‘সৃষ্টি করা’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কারণ ঈসার (আ.) জন্ম গ্রহণ পিতাবিহীন সাধারণ নিয়মের বিপরীত বিস্ময়করভাবে সংগঠিত হয়েছিল। অপরদিকে চল্লিশ নাম্বার আয়াতে ইয়াহইয়ার (আ.) আগমণের সুসংবাদকে ‘করা’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কারণ ইয়াহইয়ার (আ.) জন্ম গ্রহণ স্বাভাবিক নিয়মে সংগঠিত হয়েছিল। (আল-বাহ্র আল-মুহীত, আবু হাইয়্যান: ৩/১৫৮) ।
(গ) আল্লাহ তায়ালা নিজ ইচ্ছায় কোন কিছু করতে চাইলে যা চান তা তৎক্ষণাৎ করে ফেলেন। (তাফসীর আল-তাবারী: ৬/৪২১) । এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
৩। পঁয়তল্লিশ থেকে পঞ্চাশ নাম্বার আয়াতে ঈসার (আ.) দশটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) দুনিয়াতে অহী প্রদান এবং আখেরাতে জান্নাত দানের মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হবে।
(খ) আখেরাতে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
(গ) দোলনায় থাকাবস্থায় তার মায়ের পবিত্রতা ঘোষণার জন্য শিশুকালে মানুষের সাথে কথা বলেছেন ও বৃদ্ধাবস্থায় পুনরায় ফিরে এসে তাদেরকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিবেন।
(ঘ) কথায় ও কাজে নেক্কার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
(ঙ) তিনি পিতা বিহীন মারইয়ামের গর্ভে অলৌকিভাবে সৃষ্টি হয়েছেন।
(চ) তাকে হস্তলিপি, প্রজ্ঞা, তাওরাত এবং ইনজীল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
(ছ) তিনি বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসূল ছিলেন।
(জ) রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য তাকে চারটি মুজেযা প্রদান করা হয়েছে।
(ঝ) তিনি তাওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন।
(ঞ) বনী ইসরাঈলের উপর যা হারাম করা হয়েছিল তার মধ্য থেকে কিছু অংশ তিনি হালাল করেছেন।
৪। উনপঞ্চাশ নাম্বার আয়াতে ঈসার (আ.) প্রতি চারটি মুজেযা বর্ণনা করা হয়েছে:
(ক) মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফ‚ঁক দিলে জীবন্ত পাখি হওয়া।
(খ) জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করা।
(গ) আল্লাহর হকুমে মৃতকে জীবিত করা।
(ঘ) কারো ঘরে যা খাওয়া হয়েছে ও যা জমা রাখা হয়েছে তা সম্পর্কে সংবাদ দিতে পারা। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
৫। পঞ্চাশ নাম্বার আয়াতের শেষাংশ থেকে পরিলক্ষিত হয় যে,
(ক) বনী ইসরাঈল যুগ যুগ ধরে শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কারের মধ্যে নিমজ্জিত থাকায় তা থেকে বেড়িয়ে আসা তাদের জন্য মোটেই সহজ ছিলো না। এজন্য আল্লাহ তায়ালা মু’জেযার কথা পুনরাবৃত্তি করেছেন, যাতে তার কথাগুলো তাদের অন্তরে গেথে যায় এবং তাদের চরিত্রকে প্রভাবিত করে।
(খ) আল্লাহর ভয় তাঁর রাসূলের অনুসরণকে আবশ্যক করে। এজন্য ঈসা (আ.) তার বংশধরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তোমরা যদি আল্লাহকে সত্যিকারে ভয় করে থাকো, তাহলে আমি যা আদেশ দিচ্ছি, তা অনুসরণ করা তোমাদের উপর আবশ্যক। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৩১) ।
৬। একান্ন নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় যে,
(ক) ‘তাওহীদ রুবুবিয়্যাহ’ পরিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়া ‘তাওহীদ উলুহিয়্যাহ’ মেনে নেওয়াকে আবশ্যক করে। কাফির-মুশরিকরা ‘তাওহীদ রুবুবিয়্যাহ’ কে আংশিক মানার কারণে ‘তাওহীদ উলুহিয়্যাহ’ কে অস্বীকার করে থাকে।
(খ) একান্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করাই হলো ‘সিরাতুল মুসতাকীম’। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, ফখরুদ্দীন আল-রাযী: ৮/২৩১) ।
আয়াতাবলীর আমল:
(ক) দ্বীনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ের হাক্বীকত বা হেকমাত বুঝার জন্যে ব্যাখ্যা তলব করা।
(খ) আল্লাহকে ভয় এবং রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করা।