شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (18) إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ (19) فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ (20) ﴾ [سورة آل عمران: 18-20].
আয়াতাবলীর আলোচ্যবিষয়: একাত্ববাদী আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন হলো ইসলাম।
আয়াতাবলীর সরল অনুবাদ:
১৮। আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; আর ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীগণও (একই সাক্ষ্য দেন); তিনি ন্যায়প্রতিষ্ঠাকারী। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
১৯। নিশ্চয় (গ্রহণযোগ্য) দ্বীন হচ্ছে আল্লাহর নিকট ইসলাম। মতানৈক্য করে নাই আহলে কিতাবগণ তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর ব্যতীত পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে কুফরী কওে আল্লাহর আয়াতাবলীর সাথে, নিশ্চয় আল্লাহ দ্রæত হিসাব গ্রহণকারী।
২০। অতঃপর যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে, তবে বলে দিন: আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি আল্লাহর জন্যে, এবং আমার অনুসারীগণও। এবং বলো আহলেকিতাবদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে: তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছো? সুতরাং যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তারা অবশ্যই হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে; আর যদি তারা ফিরে যায়, তাহলে তোমার দায়িত্ব শুধু পৌঁছিয়ে দেওয়া; আর আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা বান্দাদের সম্পর্কে।
আয়াতাবলীর ভাবার্থ:
নাজরান থেকে আগত খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস, ইহুদীদের চক্রান্ত এবং কোরাইশ গোত্রের শিরকী কার্যকলাপের জবাব উল্লেখিত আয়াতাবলীতে নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে:
(ক) আল্লাহ তায়ালার একাত্ববাদের স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য তিনটি বস্তুকে সাক্ষী বানানো হয়েছে: তাঁর একাত্ববাদের সাক্ষী তিনি নিজেই, ফেরেশতাগণ এবং বিশেষজ্ঞগন।
(খ) তাঁর একাত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদানের অর্থ হলো একাত্ববাদী ধর্ম ইসলামকে মেনে নেওয়া; কারণ ইসলামই আল্লাহ তায়ালার একমাত্র মনোনীত একাত্ববাদী ধর্ম।
(গ) মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি বিদ্বেষের কারণে ইহুদী-খৃষ্টানরা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও একাত্ববাদী আল্লাহ এবং তাঁর একাত্ববাদী দ্বীনকে নিয়ে মতবিরোধ করে থাকে।
(ঘ) যারা আল্লাহর একাত্ববাদকে অস্বীকার করবে আল্লাহ তায়ালা তাদের থেকে হিসাব গ্রহণ করবেন। আর আল্লাহ তায়ালা যাদের থেকে হিসাব গ্রহণ করবেন, তাদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হবে।
এত সুন্দর যৌক্তিক দলিল পাওয়ার পরেও যদি ইহুদী-খৃষ্টানরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে মতবিরোধে লিপ্ত হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে (সা.) তাদের মতবিরোধের উত্তরে নিম্নের তিনটি কাজ করতে বলেছেন:
(ক) তিনি যেন তাদের কাছে তার ও তার অনুসারীগণের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।
(খ) তাদেরকে যেন ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহবান করেন।
(গ) রাসূলুল্লাহকে (সা.) তাদের উপর বল প্রয়োগ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর দায়িত্ব হলো শুধু ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া, তারা চাইলে ইসলাম গ্রহণ করবে, আর না চাইলে গ্রহণ করবে না, এটা একান্তই তাদের ব্যাপার। ইসলাম গ্রহণ করলে হিদায়াত প্রাপ্ত হবে, আর না করলে পথভ্রষ্ট হবে।
(ঘ) তাদের সাথে বাড়াবাড়ি না করে, বরং তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন; কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের কর্মকান্ড স্বচক্ষে দেখছেন। (আইসার আল-তাফসীর: ১/২৯৬-২৯৭, আল-তাফসীর আল-মুয়াস্সার: ১/৫২, আল-মোন্তাখাব: ১/৮৬) ।
আয়াতাবলীর অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
﴿شَهِدَ﴾ “সাক্ষ্য দিয়েছেন”, আয়াতাংশ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সংবাদ দিয়েছেন। আরবী ভাষায় ‘শাহাদাহ’ শব্দটি ‘সংবাদ দেওয়া’ অর্থে ব্যবহার হলে তার মধ্যে সরাসরি দেখে অথবা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জেনে সংবাদ দেওয়ার অর্থ নিহিত থাকে, যা দলীল হিসেবে গণ্য হয়। সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: “আল্লাহ তায়ালা নিজে তাঁর একাত্ববাদের সংবাদ দিয়েছেন, ফেরেশতাগণ এ সংবাদ রাসূলদেরকে (আ.) দিয়েছেন, রাসূলগণ (আ.) এ সংবাদ ওলামায়ে কেরামকে দিয়েছেন এবং ওলামায়ে কেরাম এ সংবাদকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন”। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৬৮, তাফসীর আল-মারাগী: ৩/১১৭)।
﴿أُولُو الْعِلْمِ﴾ “বিশেষজ্ঞগণ”, প্রায় সকল তাফসীর গ্রন্থে অত্র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: ‘বিশেষজ্ঞগণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: নবী-রাসূলগণ এবং অহীর জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম। (তাফসীর আল-নাসাফী: ১/২৪২, তাফসীর গরীব আল-কোরআন: ৩/১৮) ।
﴿الْقِسْطِ﴾ “ন্যায়পরায়ণতা”, কথা, কাজ ও রায় প্রদানে ন্যায়পরায়ণতাকে বুঝানো হয়েছে (তাফসীর গরীব আল-কোরআন: ৩/১৮)। আয়াতে ‘ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত’ দ্বারা কার অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে? এ বিষয়ে কয়েকটি মত পাওয়া যায়:
(ক) অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে, এখানে আল্লাহর অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।
(খ) কোন কোন তাফসীরকারকগণের মতে, আয়াতে ‘উলুল ইলম’ বা আলেমদের অবস্থা বুঝানো হয়েছে। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, রাযী: ৭/১৭০) ।
﴿أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ﴾ “আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি”, আয়াতাংশে প্রথম শব্দ ‘আসলামতু’ দ্বারা ‘আমি একনিষ্ঠভাবে সোপর্দ করেছি’ বুঝানো হয়েছে। আর দ্বিতীয় শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: সকল অঙ্গপ্রতঙ্গের কর্ম। এখানে অংশ উল্লেখ করে পুরোটাকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ হবে: আমার সকল কৃতকর্ম একমাত্র আল্লাহর জন্য সোপর্দ করেছি। (আইসার আল-তাফাসীর, আল-জাযায়িরী: ১/২৯৭, তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/২০) । একই অর্থে সূরা আনয়াম এর ১৬২ নাম্বার আয়াত এসেছে।
﴿الْأُمِّيِّينَ﴾ “নিরক্ষর”, এর দ্বারা আরবের মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ মুশরিকদের স্বভাব হলো লেখা-পড়া না করা। (তাফসীর গরীব আল-কোরআন, কাওয়ারী: ৩/২০) । তবে আয়াতের শিক্ষা ব্যাপক হওয়ার কারণে এর দ্বারা সকল মুশরিকদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
উল্লেখিত আয়াতাবলীর সাথে পূর্বের আয়াতাবলীর সম্পর্ক:
সূরার প্রথমাংশে আল্লাহর একাত্ববাদের আলোচনা ও তার স্বপক্ষে দলীল পেশ করা হয়েছে, (১০-১৩) নাম্বার আয়াতসমূহে একাত্ববাদকে অস্বীকারকারীর শাস্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং (১৫-১৭) নাম্বার আয়াতে যারা একাত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার পাশাপাশি তাক্বওয়ার গুণে গুনান্বিত হয় তাদের পুরস্কার বর্ণনা করা হয়েছে। আর অত্র আয়াত তথা (১৮-২০) নাম্বার আয়াতে সূরার প্রথমাংশে আল্লাহর একাত্ববাদের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলীলকে সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে সূদৃঢ় করা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতাবলীর সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক স্পষ্ট। (নাযম আল-দুরার, আল-বাক্বায়ী: ৪/২৮৭) ।
১৮ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট:
রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর শাম (সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন এবং ফিলিস্তিন) থেকে আহলে কিতাবের দুইজন পন্ডিত তার কাছে আগমন করেন। মদীনার শহর দেখে তাদের একজন আরেকজনকে বললেন: শেষ যমানায় একজন নবী যে শহরে আগমণ করবেন (যা আমরা আমাদের কিতাব থেকে জেনেছি), এ শহরটি সে শহরের মতো মনে হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে প্রবেশ করে তাকে দেখে তাদের কিতাবে বর্ণিত গুণের সাথে তার অবয়বের মিল দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি কি মোহাম্মাদ?
তিনি উত্তর দিলেন: হ্যা।
তারা আবার জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি কি আহমাদ?
তিনি এবারও উত্তর দিলেন: হ্যা।
তারা বললেন: আমরা আপনাকে ‘শাহাদাহ’ বা সাক্ষ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো, সঠিক উত্তর দিতে পারলে আমরা আপনার প্রতি ঈমান আনবো এবং আপনাকে সত্যায়ন করবো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে বললেন: হ্যা, জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
তারা বললো: আল্লাহর কিতাবে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যের বাণী কি? তাদের এ প্রশ্নের উত্তরে অত্র সূরার ১৮ নাম্বার আয়াত অবতীর্ণ করা হয়। (আসাবাব আল-নুযূল, ওয়াহেদী: ১/১০১) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
১। আঠার নাম্বার আয়াতে সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সাথে আলেমদের নাম উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্মানকে সমুন্নত করেছেন। ইমাম কুরতুবী (রা.) বলেন: আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেশতাদের নামের পাশে আলেমের নাম উল্লেখ করা তাদের মর্যাদার দলীল। (তাফসীর আল-কুরতুবী: ৪/৪১) । সূরা ত্বহা এর ১১৪ নাম্বার আয়াতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) ইলম বা জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলা হয়েছে এবং সূরা ফাতের এর ২৮ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহকে আলেমরা বেশী ভয় করেন। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে আলেমের মর্যাদা বর্ণনাপূর্বক অনেকগুলো হাদীস এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো আলেম এর সংজ্ঞা কি এবং আলেম দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে?
এটা একটি সমসাময়ীক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণ মুসলিমগণ আলেমদেরকে ধর্মীয় নেতা মানার কারণে কিছু ইসলাম বিদ্বেষী মুসলিম নামধারী নাস্তিক ‘আলেম’ শব্দটিকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এটা নিয়ে অযথা প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলতে চায় যারা জানে তারাই আলেম, হোক সে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত অথবা দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের এ কথা ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত। এর স্বপক্ষে কোন দলীল নেই।
এখন মূল উত্তরে আসা যাক, রাসূলুল্লাহ (সা.) আলেমের কোন নির্দিষ্ট রুপরেখা দিয়ে না গেলেও সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের পরবর্তী সালফে সালেহীন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘আলেম’ শব্দটি দ্বারা কি বুঝানো হয়, তা উল্লেখ করার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: “যারা জানে ‘আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ তারাই আলেম”।
ইমাম ক্বাতাদাহ (র.) বলেন: আমাদের সময় বলা হতো: “অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকাটাই আলেম হওয়ার জন্য যথেষ্ট”। (তাফসীর আল-তাবারী: ২০/৪৬২) ।
রবী ইবনু আনাস (র.) বলেন: “যে আল্লাহকে ভয় করে না, সে আলেম না”।
সা’দ ইবনু ইব্রাহীম (র.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, মদীনাতে সবচেয়ে বড় আলেম কে? তিনি উত্তর দিলেন, “যিনি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করেন, তিনিই সবচেয়ে বড় আলেম”। (তাফসীরে কুরতুবী: ১৪/৩৪৩) ।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (র.) সূরা ফাতের এর ২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন: “যিনি আল্লাহর একাত্ববাদ সম্পর্কে জানেন, তাকে ভয় করেন এবং তার থেকে আশা করেন, তিনিই আলেম”। (আল-তাফসীর আল-কাবীর: ২৬/২৩৬, ৭/১৬৯) ।
ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন: “যারা জেনে বুঝে আল্লাহর ক্ষমতাকে ভয় করে তারাই আলেম” (তাফসীরে কুরতুবী: ১৪/৩৪৩) ।
ইমাম নাসাফী (র.) বলেন: “যারা আল্লাহর গুণ জানে এবং তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা করে, তারাই আলেম। আল্লাহর ব্যাপারে যে যত বেশী জানে, সে তাঁকে তত বেশী ভয় করে”। (তাফসীর আল-নাসাফী: ৩/৮৬) ।
সালফে সালেহীনের উল্লেখিত কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ সম্পর্কে যিনি জানেন এবং তাঁকে ভয় করেন, তিনিই আলেম। এ কথাকে আরেকটু সাজিয়ে লিখলে এভাবে লেখা যায়, “যিনি অহীর জ্ঞান জানেন, আল্লাহকে ভয় করেন এবং তদানুসারে আমল করেন, তিনিই আলেম”। (আল্লাহই ভালো জানেন) । সুতরাং আলেম হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় খুবই জরুরী: (ক) অহীর জ্ঞান, (খ) আল্লাহর ভয় এবং (গ) জ্ঞান অনুসারে আমল।
যুগ যুগ ধরে আলেম শব্দের এ কনসেপ্ট সমাজে প্রচলিত। হঠাৎ করে কেউ এটাকে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ভিন্ন খাতে চালানোর অপচেষ্টা চালালে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
২। এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে, একাত্ববাদ আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত, এতদ্বসত্বেও তিনি নিজের ব্যাপারে কিভাবে সাক্ষী হন?
ইমাম ফখরুদ্দীন আল-রাযী (র.) এ প্রশ্নের উত্তরে তিনটি কথা বলেছেন:
(ক) প্রকৃত সাক্ষী আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করে সেগুলোকে তাঁর একাত্ববাদের প্রমাণ নির্ধারণ করেছেন। আর এ প্রমাণ যদি না থাকতো, তাহলে সাক্ষ্য দেওয়া শুদ্ধ হতো না। অতঃপর তিনি প্রমাণ সাব্যস্ত করে আলেমদেরকে তা জানার তাওফীক দিয়েছেন। আর যদি ঐ প্রমাণসমূহ তিনি আলেমদেরকে না জানাতেন, তাহলে তারা তাঁর একাত্ববাদকে জানতে অক্ষম হতো। ব্যাপারটা যখন এরকম, তখন একাত্ববাদের মূল সাক্ষী আল্লাহ নিজে হওয়াতে কোন দোষ নেই। এজন্যই সূরা আনয়াম এর উনিশ নাম্বার আয়াতে এসেছে:
﴿قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهادَةً قُلِ اللَّهُ شَهِيْدٌ بَيْنِيْ وَبَيْنَكُمْ﴾ [سورة الأنعام: ১৯].
অর্থাৎ: “বলো: সাক্ষী হিসেবে কার সাক্ষ্য সবচেয়ে বড়? আপনি জানিয়ে দিন, সাক্ষ্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালার, যিনি আমার এবং তোমাদের মধ্যকার সর্বোত্তম সাক্ষী” (সূরা আনয়াম: ১৯)।
(খ) আল্লাহ তায়ালা চিরকাল এবং অনন্তকালের জন্য বিরাজমান। আর তিনি ছাড়া বাকী সবকিছু অতি ক্ষ‚দ্র একটি সময় অস্তিত্বে থাকার পর বাকী পুরো সময়ে অনুপস্থিত থাকে। আর অনুপস্থিত কারো সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং সাক্ষী হিসেবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই উপযুক্ত।
(গ) আয়াতে ‘সাক্ষ্য’ শব্দটি সংবাদ প্রদান করা অর্থে এসেছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাঁর একাত্ববাদের সংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং এখানে কোন প্রশ্ন থাকে না। (আল-তাফসীর আল-কাবীর, আল-রাযী: ৭/১৬৯) ।
৩। উনিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একাত্ববাদী আল্লাহকে মেনে নেওয়ার অর্থ হলো তাঁর একাত্ববাদী ধর্ম ইসলামকে মেনে নেওয়া। অন্য কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন গ্রহণ করতে চাইলে, তা তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করাতো হবেই না, বরং সে ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন কোরআনে এসেছে:
﴿وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾ [سورة أل عمران: ৮৫]
অর্থাৎ: “যারা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে” (সূরা আলে-ইমরান: ৮৫) ।
আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো যদি কেউ স্বেচ্ছায় বুঝেশুনে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তাহলে এর জন্য সে আখেরাতে পুরস্কার পাবে। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন বিপদআপদ, ঝরতুফান এবং যেকোন আশংকাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে এক মুহুর্তের জন্য হলেও তার থেকে ইসলাম এবং আল্লাহকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে থাকেন। যেমন কোরআনে এসেছে:
﴿أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ﴾ [سورة آل عمران: ৮৩].
অর্থাৎ: “তারা কি আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে? অথচ আসমান-যমীনের সবকিছুই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তার কাছে আত্মসমর্পণ করে, এবং তারা সকলে তাঁরই দিকে ফিরে যাচ্ছে” (সূরা আলে-ইমরান: ৮৩) ।
৪। বিশ নাম্বার আয়াতে, ইসলাম বিরোধীরা যদি ইসলামী দায়ীদের সাথে একাত্ববাদের বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয় অথবা দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের সাথে দায়ীরা কি আচরণ করবে তা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে:
প্রথমত: তারা একাত্ববাদের বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হলে দায়ী তার এবং তার অনুসারীদের অবস্থান দলীল সহ বিরোধীদের কাছে স্পষ্ট করবে।
দ্বিতীয়ত: তাদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাসের দিকে আহবান করবে। এ সম্পর্কে সূরা আলে-ইমরানের আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ﴾ [سورة آل عمران: ৬৪].
অর্থাৎ: “হে আল্লাহর নবী! আপনি বলুন, হে আহলে কিতাব! এসো আমরা এমন এক কথার উপর একমত হই, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে এক ও অভিন্ন; আমরা উভয় দল আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবো না, তার সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহকে বাদ আমাদের মধ্য থেকে কাউকে প্রভ‚ বানাইবো না” (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
তৃতীয়ত: তারা যদি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে পর্যায়ক্রমে তিনটি কাজ করবে:
(ক) তাদেরকে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের স্বপক্ষে সাক্ষী রাখবে, এ সম্পর্কে আরেকটি আয়াতে এসেছে:
﴿فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾ [سورة آل عمران: ৬৪].
অর্থাৎ: “অতঃপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলুন: তোমরা সাক্ষী থেকো আমরা মুসলিম হয়েছি” (সূরা আলে-ইমরান: ৬৪) ।
(খ) নিজেদের দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্যে তাদেরকে ‘ইবতেহাল’ এর দিকে আহবান করবে। আর ‘ইবতেহাল’ হলো দুই দলই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী দলের উপর গযব বর্ষণের দোয়া করবে। এ সম্পর্কে সূরা আলে-ইমরানের একষাট্টি নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
﴿فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ﴾ [سورة آل عمران: ৬১].
অর্থাৎ: “সত্যজ্ঞান তাদের কাছে পৌঁছার পরেও যদি তারা আপনার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে আপনি তাদেরকে বলে দিন: এসো আমরা আমাদের ও তোমাদের ছেলেদের, আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদেরকে ডেকে একত্রে জড়ো হয়ে দোয়া করবো; আমাদের মধ্যে যে দল মিথ্যাবাদী তার উপর যেন আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়” (সূরা আলে-ইমরান: ৬১া) ।
(গ) তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করবে, কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তাদেরকে যথসময়ে পাকড়াও করবেন। এ সম্পর্কে সূরা মুজ্জাম্মেল এর একটি আয়াতে এসেছে:
﴿وَذَرْنِي وَالْمُكَذِّبِينَ أُولِي النَّعْمَةِ وَمَهِّلْهُمْ قَلِيلًا – إِنَّ لَدَيْنَا أَنْكَالًا وَجَحِيمًا – وَطَعَامًا ذَا غُصَّةٍ وَعَذَابًا أَلِيمًا﴾ [سورة المزمل: ১১-১৩].
অর্থাৎ: “মিথ্যা সাব্যস্তকারী ও সম্পদের অধিকারীদের সাথে ফয়সালার ব্যাপারটা তুমি আমার কাছে ছেড়ে দাও এবং কিছুদিনের জন্য তাদেরকে অবকাশ দিয়ে রাখো। অবশ্যই আমার কাছে এদের পাকড়াও করার জন্য শেকল আছে এবং আছে শাস্তি দেওয়ার জন্য জাহান্নাম। আরো রয়েছে গলায় আটকে যাবে এমন খাবার এবং যন্ত্রণা দিবে এমন ধরণের আযাব” (সূরা মুজ্জম্মিল: ১১-১৩) ।
৫। বিশ নাম্বার আয়াত থেকে বুঝা যায় মুশরিকরা লেখাপড়া না করার কারণে শিরকে লিপ্ত হয়। মূলত মুশরিকদের একাত্ববাদের বিষয়ে লেখা-পড়া কম থাকার করণেই শিরকে জড়িয়ে পড়ে। এজন্য হিন্দু ধর্ম সহ অন্যান্য ধর্মে দেখা যায় অনুসারীদের জন্য ধর্মীয় শা¯্র পাঠ করা বৈধ নয়। ফলে, অজ্ঞতাবশত তারা এমন এমন শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, যা সুস্থ কোন বিবেগ মেনে নিতে পারে না। এমনকি মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় যে দলগুলো শিরক-বিদয়াতে লিপ্ত, তারা নিজ দলের লেখা কিছু চটি বই ছাড়া বাহিরের কোন বই তাদের অনুসারীদেরকে পাঠ করতে অনুমতি দেয় না। অত্র আয়াতের মূল শিক্ষা হলো-কোরআন-হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থ সহ বিষয়ভিত্তিক সকল পড়তে হবে, যাতে আমাদেরকে মুর্খত স্পর্শ করতে না পারে; কারণ যখনই কাউকে মুর্খতা পেয়ে বসে, তখন সে যে কোন ধরণের শিরক-বিদয়াতে লিপ্ত হতে পারে। এজন্য ইসলাম সর্বদা পড়ার প্রতি উৎসাহিত করেছে। (আল্লাহই ভালো জানেন) ।
৬। আঠার নাম্বার আয়াতের ফযিলত সম্পর্কে জুবায়ের ইবনু আওয়াম থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন:
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- وَهُوَ بِعَرَفَةَ يَقْرَأُ هَذِهِ الْآيَةَ ﴿شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُوا الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾ وَأَنَا عَلَى ذَلِكَ مِنْ الشَّاهِدِينَ يَا رَبِّ” (مسند أحمد: ১৪২১).
অর্থাৎ: “আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহকে (সা.) আঠার নাম্বার আয়াতটি পড়ার পর “হে রব! আমিও এর উপর সাক্ষীদের অন্তর্ভূক্ত” পড়তে শুনেছি” (মুসনাদে আহমাদ: ১৪২১)।
আয়াতের আমল:
(ক) আলেমদের সাথে সদাচরণ করা।
(খ) ইসলামকে একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করা।
(গ) একজন ইসলামী দায়ীকে সংযত হয়ে বিরোধীদের সাথে নিম্নের আচরণ করা: (র) তাদের কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবে, (রর) তাদেরকে বিশুদ্ধ আক্বীদার দিকে আহবান করবে এবং (ররর) দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করবে।
(ঘ) হজ্জ পালনকারীদের জন্য আঠার নাম্বাত আয়াত আরাফার ময়দানে বেশী বেশী তেলাওয়াত করা।