إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا (17) يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا (18) وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا (19) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (20) إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21) لِلطَّاغِينَ مَآبًا (22) لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا (23) لَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا (24) إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا (25) جَزَاءً وِفَاقًا (26) إِنَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا (27) وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا كِذَّابًا (28) وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا (29) فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا (30) [سورة النبأ: 17-30]
আয়াতের আলোচ্য বিষয়: কিয়ামতের অবস্থা এবং সেখানকার শাস্তির ধরণ।
আয়াতের সরল অনুবাদ:
(১৭) নিশ্চয় ফয়সালার দিন নির্ধারিত আছে।
(১৮) সেদিন সিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন তোমরা দলে দলে আসবে।
(১৯) আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে, ফলে তা বহু দ্বারবিশিষ্ট হবে।
(২০) আর পাহাড়সমূহকে চলমান করা হবে, ফলে সেগুলো মরীচিকা হয়ে যাবে।
(২১) নিশ্চয় জাহান্নাম গোপন ফাঁদ।
(২২) সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন স্থল।
(২৩) সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।
(২৪) সেখানে তারা কোন শীতলতা আস্বাদন করবে না এবং না কোন পানীয়।
(২৫) ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া।
(২৬) উপযুক্ত প্রতিফল স্বরুপ।
(২৭) নিশ্চয় তারা হিসেবের আশা করতো না।
(২৮) আর তারা আমার আয়াতসমূহকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছিল।
(২৯) আর সবকিছুই আমি লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছি।
(৩০) সুতরাং তোমরা স্বাদ গ্রহণ করো, আমি তো কেবল তোমাদের আযাবই বৃদ্ধি করবো।
আয়াতের ভাবার্থ:
নিশ্চয় পূর্বে যারা এসেছিলো এবং পরে যারা আসবে সকলের জন্য কিয়ামতের দিন নির্ধারিত রয়েছে, যেদিন সকল প্রাণীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। সেদিন সিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁক দেওয়া হবে, তখন মানুষ তাদের দলনেতার সাথে দলে দলে হাশরের ময়দানে জড়ো হবে। আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে, ফলে তা বহু দ্বারবিশিষ্ট হবে এবং সেখান থেকে ফেরেশতারা হাশরের ময়দানে অবতরণ করবে। আর পাহাড়সমূহকে চলমান করা হবে, ফলে সেগুলো মরীচিকার রুপ ধারণ করে নিশ্চিন্থ হয়ে যাবে। নিশ্চয় জাহান্নাম পাপীদের জন্য গোপন ফাঁদ এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন স্থল। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। উপযুক্ত প্রতিফল স্বরুপ সেখানে তারা ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া কোন শীতলতা এবং কোন পানীয় আস্বাদন করবে না। নিশ্চয় তারা দুনিয়ায় হিসাবের আশা করতো না। আর তারা আমার আয়াতসমূহকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করতো। আর আমি তাদের সকল অপকর্মকে লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছি। সুতরাং তারা এ আযাবের স্বাদ গ্রহণ করবে, আমি তো কেবল তাদের আযাবই বৃদ্ধি করবো। (আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০৩-৫০৪, আল-তাফসীর আল-মোয়াস্সার: ১/৫৮২, আল-মোন্তাখাব: ৮৭৯) ।
সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের অস্পষ্ট শব্দের ব্যাখ্যা:
(بَرْدًا) ‘ঠান্ডা’, অধিকাংশ তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অত্র আয়াতাংশ দ্বারা দুইটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে:
(ক) জাহান্নামের আযাব শিথিল করা, সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: “তাদের জন্য সেখানে জাহান্নামের আযাব শিথিল করা হবে না”।
(খ) তন্দ্রা বা ঘুম, সুতরাং আয়াতের অর্থ হবে: “তারা সেখানে ঘুমানোর সুযোগ পাবে না”। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১৯, আইসার আল-তাফাসীর: ৫/৫০৩) ।
সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের সাথে পূর্ববর্তী আয়াতের সম্পর্ক:
পূর্ববর্তী আয়াত তথা (১-১৬) নাম্বার আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা এ ইউনিভার্সকে পুরোপুরি ধ্বংস করে নুতন এক জগৎ সৃষ্টি করে সেখানে সকল প্রাণীকে জড়ো করে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে সক্ষম। আর অত্র আয়াতাবলী তথা (১৭-৩০) নাম্বার আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে যে, কিয়ামত কখন সংগঠিত হবে তা পূর্ব নির্ধারিত, যা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। অনুরুপভাবে কিয়ামতের অবস্থা ও জাহান্নামের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং পূর্বের আয়াতের সাথে অত্র আয়াতাবলীর সম্পর্ক সুস্পষ্ট। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১৬) ।
সূরা আন-নাবা এর (১৭-৩০) আয়াতের শিক্ষা:
১। অত্র সূরার সতের নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য নির্ধারিত, যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে রয়েছে। অতঃপর (১৮-২০) নাম্বার আয়াতে কিয়ামতের তিনটি ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
(ক) ইসরাফীল (আ.) এর সিঙ্গায় দ্বিতীয় ফ‚ঁকের পরে সকল প্রাণী কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে জড়ো হবে। আর মানুষ তাদের নেতার সাথে দলে দলে ময়দানে মাহশারে একত্র হবে। এ সম্পর্কে কোরআন মাজীদের সূরা ইসরা এর একাত্তর নাম্বার আয়াতে এসেছে:
(يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ فَمَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَأُولَئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَابَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا) [الإسراء: ৭১] .
অর্থাৎ: “যেদিন আমি প্রত্যেক জাতিকে তাদের নেতাদের সাথে ডাকবো, সেদিন যাদের আমলনামা ডানহাতে দেওয়া হবে, তারা পড়া শুরু করবে, তাদের উপর সেদিন বিন্দুমাত্র যুলম করা হবে না” (সূরা ইসরা: ৭১) ।
(খ) সেদিন আকাশ ফেটে বহু দরজা বিশিষ্ট হবে এবং ফেরেশতাগণ আকাশ থেকে অবতরণ করবে। এর মাধ্যমে বিশ্ব রুপরেখা এবং রীতিনীতি সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর আল্লাহ তায়ালা অস্থায়ী রাজাবাদশাহদের কাছ থেকে সকল ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি একক ক্ষমতার অধিকারী হবেন। এ সম্পর্কে সূরা ইনফিতার এবং সূরা ইনশিক্বাক এর প্রথম আয়াতাবলীতে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়াও সূরা ফুরকান এর পচিশ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
(وَيَوْمَ تَشَقَّقُ السَّمَاءُ بِالْغَمَامِ وَنُزِّلَ الْمَلَائِكَةُ تَنْزِيلًا (২৫) الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمَنِ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا (২৬)) [سورة الفرقان: ২৫-২৬].
অর্থাৎ: “এবং যেদিন আকাশ তার মেঘমালা নিয়ে ফেটে পড়বে, আর দলে দলে ফেরেশতারা যমীনে নেমে আসবে। সেদিন চুড়ান্ত বাদশাহী হবে একমাত্র দয়াময় আল্লাহ তায়ালার জন্যে, যারা তাকে অস্বীকার করেছে তাদের উপর সেদিনটি হবে খুবই কঠিন” (সূরা ফুরকান: ২৫) ।
(গ) পাহাড়গুলোকে তাদের জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলে সমতল করা হবে, ফলে তা মরীচিকার মতো হয়ে যাবে (আন-নাবা: ২০), তা সম্পূর্ণরূপে চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ হয়ে ধুলাবালিতে রুপান্তরিত হবে (ওয়াক্বিয়া: ৫-৬) এবং তা এক পর্যায়ে বাতাশে ধুনা তুলার মতো উড়তে থাকবে (আল-ক্বারিয়াহ: ৫/ ত্বহা: ১০৫/ আন-নমল: ৮৮) ।
২। অত্র সূরার (২১-২৬) আয়াতে কিয়ামতের দিন হতভাগা কাফের-মোশরেকদের ও সীমালঙ্ঘনকারীদের পাঁচটি ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে:
(ক) জাহান্নাম তাদের জন্য গোপন ফাঁদ হবে।
(খ) জাহান্নাম হবে তাদের একমাত্র আবাসস্থল।
(গ) তারা সেখানে যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।
(ঘ) তাদের জন্য সেখানে ঘুমানোর কোন সুযোগ থাকবে না, অথবা তাদের জন্য শাস্তিকে বিন্দুমাত্র শিথিল করা হবে না।
(ঙ) জাহান্নামে তাদের পানীয় হবে ফুটন্ত পানি ও পুজ।
৩। অত্র সূরার (২৭-২৮) নাম্বার আয়াতে কাফিররা উল্লেখিত শাস্তির উপযোগী হওয়ার দুইটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে:
(ক) দুনিয়ায় থাকা কালে তারা মনে করতো কিয়ামতের দিন কোন হিসাবনিকাশ হবে না।
(খ) তারা আল্লাহর আয়াতবলীকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করতো।
৪। উনত্রিশ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা সকলের কৃতকর্ম কিতাবে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন, যার আলোকে কিয়ামতের দিন বিচার হবে।
৫। ত্রিশ নাম্বার আয়াতে কাফিররা জাহান্নামে প্রবেশের পর তাদেরকে লাঞ্চিত করার জন্য একটি ঘোষণা দেওয়া হবে: তোমরা দুনিয়াতে আল্লাহর অবাধ্য ছিলে, এখন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করো, আজ তোমাদের জন্য শাস্তি কেবল বাড়ানো হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন: জাহান্নামীদের জন্য অত্র আয়াতের চেয়ে অধিক কষ্টের আয়াত আর দ্বিতীয়টি নেই। (তাফসীর আল-মুনীর: ৩০/১৯) ।
আয়াতাবলীর শিক্ষা:
(ক) পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান এনে আখেরাত ভিত্তিক জীবনযাপন করা।
(খ) আল্লাহর আয়াতাবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।